পি কে হালদারকে ফেরৎ দেয়া ক্রিসমাস কার্ড বিনিময়ের মতো সহজ নয়ঃবিক্রম দোরাইস্বামী
পি কে হালদারকে ফেরৎ দেয়া ক্রিসমাস কার্ড বিনিময়ের মতো সহজ নয়ঃবিক্রম দোরাইস্বামী
সংবাদটি পড়েছেন:267,781
ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের গ্রেপ্তার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর মধ্যে পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে ওই আলোচনা হয়।
শনিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আটক হন বাংলাদেশে সিরিজ আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা পি কে হালদার। যত দ্রুত সম্ভব তাকে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে চায় ঢাকা। বহুল আলোচিত ওই গ্রেপ্তার এবং পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে মঙ্গলবারের বৈঠকে এই প্রথম দু’দেশের মধ্যে এমন আলোচনা হলো। বৈঠকে পি কে হালদারের প্রত্যর্পণ বিষয়েও কথা হয়। বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় দূত বলেন, অপরাধী হস্তান্তর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তবে এর নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে, আমরা ‘ক্রিসমাস কার্ড’ বিনিময় করছি। পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া পি কে হালদারকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে সময় লাগতে পারে।
কারণ, এসব বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। পি কে হালদারের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, এ নিয়ে কথা হয়েছে। এটি দুই দেশের নিয়মিত সহযোগিতার একটি অংশ। দুই দেশের অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য পারস্পরিক আইনি সহায়তাসহ নানা ধরনের কাঠামো রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তথ্য দিয়েছে। ভারতীয় সংস্থা ওই তথ্য যাচাইয়ের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও অপরাধীদের দমনের জন্য সহযোগিতা রয়েছে। পি কে হালদারকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ অনুরোধ করেছে কিনা, জানতে চাইলে ভারতের হাইকমিশনার বলেন, ‘দেখুন এটি একটি আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। গত সপ্তাহে ছুটির দিনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে একটা সময় বাংলাদেশকে জানানো হবে।
ওদিকে পি কে হালদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে কলকাতা নগর দায়রা আদালতে তাকে হাজির করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। আদালতে ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় ইডি। সিবিআই স্পেশাল কোর্টের বিচারক মাসুক হোসেইন খান ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত ১৪ই মে পি কে হালদার ধরা পড়েন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) ফাঁদে। এ সময় পি কে হালদারের স্ত্রী ও ভাই প্রাণেশ হালদারসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ই মে বারাসাতের আদালতে তোলা হলে তদন্তের স্বার্থে তাদের ১৭ই মে পর্যন্ত তিন দিনের ইডি হেফাজতে নেয়ার নির্দেশ দেন বিচারক। এক বিবৃতিতে ইডি বলেছে, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পি কে হালদার নাম পাল্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে বসবাস করতেন। প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশি নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রশান্ত কুমার হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। বাংলাদেশি এ অর্থপাচারকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান এবং আধার কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশান্ত কুমার হালদারের অন্য সহযোগীরাও ভারতীয় এসব কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। এদিকে ভারতে গ্রেপ্তার পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ২০২০ সালের ১৯শে নভেম্বর জারি করা রুলের ওপর আগামী ১২ই জুন শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন হাইকোর্ট। এর পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অগ্রগতি জানাতেও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন। এর আগে শুনানিতে পি কে হালদারকে ভারতে গ্রেপ্তারের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনে দুদক। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দেশে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে এই অর্থ পাচার করেন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি ইন্টারপোল শাখার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ই জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।
পি কে হালদারকে ফেরাতে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ভারত: পররাষ্ট্র সচিব এদিকে ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আলোচিত অর্থ পাচারকারী প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে দেশে ফেরাতে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। তাকে ফেরাতে পারলে তার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ রয়েছে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি। নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে সচিব বলেন, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে পি কে হালদারের বিষয়ে তারা তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে চায়। তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আমাদের জানাবে। এ বিষয়ে ভারত আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। এ ছাড়াও ভারতে পি কে হালদারের বিষয়ে কোনো ধরনের ফিন্যান্সিয়াল ক্রিমিনিলিটি থাকলে, সেটা যদি জানায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপ নেয়া আরও সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এটি একটি আর্থিক দুর্নীতির মামলা। এটি সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ভিন্ন। ভারতের আইনের আলোকে তারা প্রথমে প্রক্রিয়াটি শেষ করবে। তারপরে আমাদের যে অনুরোধগুলো আছে সেগুলো বিবেচনায় নেবে। হাইকমিশনারের সঙ্গে আলাপে ঢাকার তরফে নির্দিষ্টভাবে কী অনুরোধ করা হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সহযোগিতা চেয়েছি। এখন সহযোগিতা করার অর্থ হচ্ছে পি কে হালদারকে দেশে ফেরত আনা প্রয়োজন। সেটাই আমরা বলেছি। তারা বলেছে, তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আমাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। ভারতের বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরে তাকে ফেরত দেয়া হবে কিনা? জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এটি এখনই বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে অনুরোধ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, ভারতে যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে সেটির বিচার কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু পি কে হালদারের বিষয়টি অনুসন্ধানের পর্যায়ে রয়েছে। পুরো অনুসন্ধান শেষ হওয়ার পরে কোনো আইনি কাঠামোতে বা বিকল্পভাবে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে সব সময় যে আইনি কাঠামোর প্রয়োজন হয় বিষয়টি সেরকম নয়। এর আগে আমরা দেখেছি এরকমভাবে তাদের আমরা বিভিন্ন সহযোগিতা করেছি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করেছে। পি কে হালদারকে ফেরত দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাকে ফেরত না দেয়ার কোনো কারণ নেই। এখানে বন্দিবিনিময় চুক্তি কার্যকর হবে কিনা বা হালদার বন্দি অবস্থায় আছে কিনা এগুলো আইনি প্রশ্ন। এগুলোর উত্তর দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আমি মনে করি তারা তাদের প্রক্রিয়া শেষ করে তাকে ফেরত দেবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে কাজ হচ্ছে: ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে দুই দেশ। মঙ্গলবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এ তথ্য জানান। গত এপ্রিলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। জুলাইয়ে ওই সফর হবে কিনা? জানতে চাইলে ভারতীয় দূত বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো স্পেকুলেট করতে চাই না। আশা করি, এটি আমরা দ্রুত ঠিক করে ফেলতে পারবো।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের বৈঠক ৩০শে মে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই বৈঠকে বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটি, কনস্যুলার বিষয়াদি, রাজনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।’ দুই দেশের মধ্যে সবধরনের সহযোগিতা পর্যালোচনা করা হবে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও ঠিক করবে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়। এ মাসের শেষ সপ্তাহে আসামে অনুষ্ঠিতব্য নদী কনফারেন্সে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২৮শে মে আসামে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হবে।’
ঢাকা-দিল্লি বৈঠকে পি কে হালদারকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে: বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে ৩০ শে মে অনুষ্ঠেয় সপ্তম জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন-জেসিসি বৈঠকে পি কে হালদার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর আগে ২৮ ও ২৯শে মে আসামের গৌহাটিতে নদী কনফারেন্সে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। নদী কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও উপস্থিত থাকবেন। ফলে দুই মন্ত্রীর মধ্যে আসামে আলোচনা হবে। নদী কনফারেন্স থেকে ২৯শে মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে যাবেন। ৩০শে মে বৈঠক করে পরের দিন ঢাকায় ফিরবেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরে ভারত সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের সফরের আগে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সফরসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে। কলকাতায় আটক পি কে হালদারের বিষয়ে আলোচনা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক বৈঠকে হয়তো আলোচনা নাও হতে পারে। তবে, একান্ত আলোচনা যেখানে শুধু এই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন, সেখানে এটি নিয়ে আলাপ হতেই পারে। প্রধানমন্ত্রীর সফর ছাড়া অন্য কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পানি, কানেক্টিভিটি, সীমান্ত, আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ অন্যান্য নতুন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।