বছর ঘুরে আসতে না আসতেই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ৫ মে উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে হেফাজতের ব্যানারে কোনো অনুষ্ঠান পর্যন্ত করতে পারেনি সংগঠনটি। এ উপলক্ষে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েও সরকারি চাপ ও সংগঠনটির আমির আহমদ শফীর অনিচ্ছায় ‘আল আমনাহ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করে দায় সেরেছে হেফাজত ইসলাম। এনিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছুই বলছে না। তবে গত এক বছরের হেফাজতের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন শফীর পুত্র আনাস মাদানী।
অভিযোগ রয়েছে, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে সরকারের সঙ্গে এক প্রকার সমঝোতার মধ্য দিয়ে চলছে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব। সংগঠনের যে কোনো সিদ্ধান্ত ও অনুদানের অর্থের হিসাব-নিকাশ সবই আহমদ শফীর তালুবন্দি রয়েছে। বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়া হেফাজত আমিরের সব সিদ্ধান্তই নেপথ্যে থেকে নিয়ে থাকেন তার ছেলে ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা আনাস মাদানী। ফলে হেফাজতের ব্যানারে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ সৃংগৃহীত যাবতীয় আর্থিক অনুদানও যাচ্ছে আমিরের নাম করে আনাস মাদানীর পকেটে। আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে শফী পুত্র গত এক বছরে শুধু অর্থকড়ির পেছনেই ছুটেছেন। বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন কাড়িকাড়ি টাকা। হেফাজতের নামে এসব টাকা আসলেও শাপলা চত্বরে নিহত নেতাকর্মীদের স্বজনদের দিকে না তাকিয়ে নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত ছিলেন আনাস মাদানী।
হেফাজত সূত্র জানায়, নেতাকর্মীদের প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আনাস মাদানীর একক সিদ্ধান্তের কারণে সোমবার হেফাজতের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন করা হয়নি। ‘আল আমানাহ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সোমবার বিকেলে হাটহাজারী পার্বর্তীপুর হাই স্কুল মাঠে একটি ইসলামী সম্মেলনের মাধ্যমে কোনো রকম দায় সেরেছেন হেফাজত আমির আহমদ শফী।
আগে থেকে গত বছরের এ দিনে শাপলা চত্বরের ঘটনায় হতাহতদের স্মরণে হেফাজতের ব্যানারে কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা ছিল দায়িত্বশীল নেতাদের। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা নেতাকর্মীদের বিষয়টি জানিয়েও ছিল সংগঠনটি। সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে আমিরের নির্দেশনা নিতে গত বৃহস্পতিবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা আল্লামা শফীর সঙ্গে বৈঠকও করেন। ওই বৈঠকে আল্লামা শফী দোয়া দিবস কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে নগরীর আন্দরকিল্লা মসজিদে সমোবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু পরদিন পাল্টে যায় দৃশ্যপট। এ কর্মসূচি পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ান আনাস মাদানী। সরকারের চাপ আছে তাই হেফাজতের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন করা যাবে না এমন কথা জানিয়ে আনাস মাদানী তার বাবা আহমদ শফীকে এ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনেন। এরপরও নেতাকর্মীদের প্রবল ইচ্ছা ও সমালোচনার ভয়ে হাটহাজারী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনীরের প্রতিষ্ঠিত ‘আল আমানাহ ফাউন্ডেশনের’ ব্যানারে একটি দায়সারা সমাবেশ করেছেন আহমদ শফী।
এ প্রসঙ্গে হেফাজত ইসলামের মূখপাত্র ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘দলের ব্যানারে কোনো কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে “শাহ আমানাহ ফাউন্ডেশনের” উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা সমাবেশের আর্থিক সহযোগিতা করছেন বলে তাদের ব্যানারে এ সমাবেশ করা হয়।’
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত থাকায় আনাস মাদানীর প্রভাবে গত বছর সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদরাসায় হেফাজতের ওলামা মাশায়েখ সম্মেনের কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ওই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংগঠনটিকে ঢেলে সাজানো, মজলিসে সুরা গঠন, প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কমিটি গঠন এবং দলের গঠনতন্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। শাপলা চত্বরের ঘটনায় নিহত ও আহতদের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল প্রতিটি জেলা কমিটিকেও। কিন্তু একবছরে এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি আমিরের অনীহার কারণে। আর তাকে এসব কাজে বরাবরই প্রভাবিত করছেন ছেরে আনাস মাদানী।
তবে গত বছরের ৫ মে আহমদ শফীর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে শাপলা চত্বরে অর্ধশতাধিক ধর্মপ্রাণ নিরীহ মুসলমান নিহত হন। আর এতে তাদের পরিবারের ভাগ্যের চাকা বন্ধ হয়ে গেলেও গত এক বছরে হেফাজতের কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য আনাস মাদানী ও তার সহযোগীদের সম্পদের চাকা দ্রুত সচল হয়েছে। আনাস মাদানী ও তার সহযোগীরা ইতিমধ্যে হাটহাজারী ঈদগাঁহ মাঠের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২০ কাঠা জায়গায় পাঁচটি বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। কাঠা প্রতি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের এই জমিতে ইতিমধ্যে তিনতলা পর্যন্ত অট্টালিকার নির্মাণ কাজও শেষ হয়েছে।
তবে আনাস মাদানীর দাবি, পাঁচটি নয় তিনি একটি নির্মাণ করছেন। বাকিগুলোর মালিক তিনি নন। ৫ মে’র পর হেফাজত আমির আহমদ শফীকে ভক্তদের দেয়া টাকায় এ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাটহাজারী সদরের ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণে পাশপাশি তৈরি হচ্ছে পাঁচটি ভবন। সেখানে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকরা জানিয়েছেন এই পাঁচটি বাড়ি ছয়তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে। আনাস মাদানীর মালিকানাধীন এসব বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখাশোনা করছেন তার বন্ধু আহসান উল্লাহ। তার কাছ থেকেই জমিগুলো কিনেছেন আনাস। মাঝে মাঝে আনাস মাদানীও নির্মাণ কাজ দেখতে আসেন বলে জানান শ্রমিকরা।
হাটহাজারীর এসব ভবন ছাড়াও রাঙ্গুনীয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা লিচু তলায় এগারো শতক জমির উপর রয়েছে চারতলা সুপরিসর ভবন। একবছর আগেও ভবনটি ছিল একতলা। হেফাজতের ৫ মে’র আন্দোলনের পর এ ভবনটিও চারতলা পর্যন্ত উঠে যায়। বর্তমানে এটির পাঁচতলার নির্মাণ কাজ চলছে। ‘মাদানী মঞ্জিল’ নামে এ ভবনটি জামায়াতপন্থি লোকজনের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। সেখানে একটি প্রাইভেট হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। হাটহাজারী বড় মাদরাসার ভেতর স্বপরিবার নিয়ে আহমদ শফীর স্থায়ী বাস হলেও রাঙ্গুনীয়ার শিলক তার জন্মস্থান। সেখানেও রয়েছে একটি বাড়ি ও দু’টি দ্বিতল পাকা ভবন সমৃদ্ধ মাদরাসা।
আনাসা মাদানীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে তার পক্ষে হেফাজতের মূখপাত্র মাওলানা আজিজুল হক বলেন, ‘হেফাজতের টাকায় হুজর (শফী) বা আনাস মাদানীর সম্পত্তি অর্জন করার কথা ঠিক না। তাদের বর্তমান সম্পত্তি ও টাকা পয়সাগুলো হুজুরের ভক্ত ও ছাত্ররা দিয়েছেন। এসব দিয়ে হয়তো আনাস মাদানী বাড়ি-ঘর নির্মাণ করছেন।’