‘ক্যাম্পে গিয়ে র্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেকের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম দুই কোটি টাকা দিব নজরুলকে ভিক্ষা দেন। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, আমার কাছে এসেছেন কেন? শামীম ওসমানের কাছে যান। সেই আপনার জামাইকে গুম করেছে'। এরপর র্যাবের ক্যাম্পে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে তিনি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। আমাদের সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন।’
সোমবার বিকালে কথাগুলো বলছিলেন অপহরণ ও খুনের শিকার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান। সিদ্ধিরগঞ্জের আবদুল আলীর পুল এলাকায় শহীদুল তার নিজের বাড়িতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।
শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করে বলেন, র্যাব ছয় কোটি টাকা নিয়ে নজরুলকে অপহরণ ও খুন করেছে। তার এ তথ্যের ভিত্তি কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন পাগলের মতো নজরুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন আমার কাছে একটা ফোন আসে। এতদিন এই ফোনের কথা প্রকাশ করিনি। ভেবেছিলাম নজরুলকে ফিরে পাব। কিন্তু এখন সব শেষ। তাই এখন আর কোনো ভয় নেই। ফোনটি করেছিল হাসমত আলী হাসুর বন্ধু জসিম। তিনি (শহীদ) জানান, জসিম তাকে ফোনে বলেছিল, নূর হোসেন র্যাবকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে নজরুলকে অপহরণ করিয়েছে।
ছয় কোটি টাকা কিভাবে লেনদেন হল, জানতে চাইলে নজরুলের শ্বশুর বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের (ব্যাংকের নাম উল্লেখ করেছেন শহীদ) মাধ্যমে তিন কোটি টাকা নূর হোসেন তার অ্যাকাউন্ট থেকে কর্নেল সাঈদ তারেকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে। বাকি টাকা হাসমত আলী হাসু, ওয়ার্ড কমিশনার শাহজালাল বাদল ও ইকবাল হোসেন একইভাবে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কর্নেল তারেকের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। এ টাকা ভাগাভাগি করেছে নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১ অধিনায়ক তারেক সাঈদ, মেজর জাহাঙ্গীর, মেজর রানা ও মেজর আরিফ ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলাম। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই টাকার উৎস সম্পর্কে জানা যাবে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
শহীদ চেয়ারম্যানের আরও অভিযোগ, নজরুল ইসলামসহ সাত অপহরণ ও খুনের পেছনে র্যাব-১১ এর অধিনায়কসহ তিনজন র্যাব কর্মকর্তা জড়িত। এ অপহরণ ও খুনের পেছনে শুধু র্যাব নয়, নজরুলের ঘনিষ্ঠ আÍীয়রাও জড়িত। এদের মধ্যে আছে তার আপন ছোট ভাই হাসমত আলী হাসু (এজাহারভুক্ত আসামি) ও নজরুলের আপন বড় ভাই নূর মোহাম্মদ। তিনি মনে করেন এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার ও নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল, বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু ও সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবু সুফিয়ান।
অপহরণের স্পট : শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যখন নজরুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম তখন নজরুলের বন্ধু ইদ্রিস আমাকে ফোন করে বলেন, শিবু মার্কেট এলাকা থেকে নজরুলকে তুলে নিয়ে গেছে র্যাব। এ কথা শোনার পর তিনি শিবু মার্কেট এলাকায় ছুটে যান। এ সময় সিদ্ধিরগঞ্জের শিবু মার্কেট এলাকার বেবিস্ট্যান্ডের কিছুটা আগে খালি জায়গার পাশে বালু বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন শ্রমিক। দু’জন শ্রমিকের কাছে তিনি জানতে চান, এখান থেকে তারা র্যাবের গাড়িতে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছে কি না।
তখন দুই শ্রমিক তাকে জানায়, সকাল থেকে র্যাব-১১ লেখা দুটি মাইক্রোবাস ওই ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। বেলা ১টার দিকে তারা দুটি প্রাইভেট কার থেকে বেশ কয়েকজনকে নামিয়ে র্যাবের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন। শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, এরপরই তিনি স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানকে ফোন করে এ বিষয়টি জানান। তখন শামীম ওসমান তাকে বলেন, ঘটনা তিনিও শুনেছেন। কিন্তু তার কথা প্রশাসন শুনছে না। শামীম ওসমান তখনই আবদুল মালেক নামের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান।
শহীদুল ইসলাম আরও জানান, এর কিছুক্ষণ পরই কথা আছে বলে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল তারেক সাঈদ তাকে ফোন করে র্যাবের ক্যাম্পে যেতে বলেন। এরপর নজরুলের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি র্যাবের ক্যাম্পে যান। ক্যাম্পে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় র্যাব সদস্যরা। শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, ‘র্যাবের কয়েকজন অফিসার আমাদের সঙ্গে ফাউ প্যাচাল পারতে লাগল। একবার ধমক দেয়। আরেকবার গ্রেফতারের হুমকি দেয়। কয়েক ঘণ্টা পর কর্নেল তারেক দেখা দেন। দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে ও এমপি শামীম ওসমানকে গালি দিতে শুরু করেন।’
সুযোগ নিয়েছে গিয়াস : হত্যাকাণ্ডের পেছনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি গিয়াসউদ্দীনের জড়িত থাকার অভিযোগ করে শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি গিয়াসকে ফোন করে বললাম ভাই, আমার বিপদের দিনে একটু পাশে দাঁড়ান।’ কিন্তু গিয়াসের ‘খাস লোক’ ইকবালকে (সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপি নেতা ও কফিল উদ্দীন হত্যা মামলার আসামি) অপহরণ মামলায় আসামি করায় সে আমার পাশে দাঁড়ায়নি। উল্টো অপহরণের পরদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে নজরুলের মালিকানাধীন মার্কেট দখল করে নিয়েছে। শহীদ বলেন, এর আগে এ মার্কেট দখলের জন্য সন্ত্রাসীদের দুই কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল গিয়াস। নজরুল অপহরণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে মার্কেটটা দখল করে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান : শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, নজরুল রাজনীতি করতে গিয়ে তেমন কোনো সহায় সম্বল রেখে যেতে পারেননি। নজরুলের দুই মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। ছেলেটা ভারতে পড়ে। তাদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। তিনি বলেন, এত বড় ঘটনা ঘটেছে তাই মিডিয়া এত হৈচৈ করছে। কিন্তু নূর হোসেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিদ্ধিরগঞ্জে জুয়া-মাদকের আড্ডা চালিয়ে আসছিল। তখন মিডিয়া কিছু বলেনি। কিছুদিন পর মিডিয়া এ ঘটনাও ভুলে যাবে। সবাই চুপ মেরে যাবে। কারও বিচার হবে না। কিন্তু আমরা নজরুলকে ফিরে পাব না। এ ঘটনাও ভুলতে পারব না। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাকে সব খুলে বলতে চাই। তিনিই শুধু আমাদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে পারেন। আর কেউ নয়।
নূর হোসেন প্রভাবশালীর শেল্টারে : শহীদ চেয়ারম্যান দাবি করে বলেন, নূর হোসেন পালিয়ে যায়নি। সে ঢাকায় একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলের শেল্টারে আছে। ওই মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে যৌথভাবে নূর হোসেন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ চার লেন রাস্তা নির্মাণের সামগ্রী সরবরাহ করছে। তিনি দাবি করেন ঢাকায় ওই মন্ত্রীর বাসায় অভিযান চালালেই নূর হোসেনকে পাওয়া যাবে।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহƒত হন। এরপর ৩০ এপ্রিল সাতজনের অর্ধগলিত দেহ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।