ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনেছেন অংশ নেয়া বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা। সদ্য সাবেক সংসদ সদস্যদের যারা পরাজিত হয়েছেন তাদেরও অনেকে এমন অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন কমিশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও দাখিল করেছেন কেউ কেউ।
পরাজিত হওয়া এমপিদের কেউ বলছেন, মৃত ব্যক্তিদের ভোটও কাস্ট করা হয়েছে। আবার কেউ বেআইনিভাবে ভোট গণনা ও ফলাফল বিবরণী প্রস্তুত করার অভিযোগ এনেছেন। এ ছাড়া সুবিধাভোগীর কার্ড আটকে রেখে অন্য প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা, প্রশাসনের অসহযোগিতা, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও ভোটের হার বেশি দেখানোর অভিযোগ এনেছেন কেউ কেউ।
দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবারের ভোটে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগেরই বেশ কয়েকজন নেতা। তারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। নৌকা নিয়ে হেরে যাওয়ার তালিকায় রয়েছেন-আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী দুইবারের সংসদ সদস্য এডভোকেট মাহবুব আলী, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী দুইবারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী তিনবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য। এ ছাড়া ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করে হেরে যান। এসব প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন।
মাদারীপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ও দলটির প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে গত মঙ্গলবার বলেছেন, নির্বাচনে নৌকার ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দিয়েছে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থকরা। তারা কালকিনি পৌরসভাসহ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে নৌকার পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়েছে।
বিশেষ করে কালকিনি পৌরসভার ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি কেন্দ্র তারা দখলে নিয়ে ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি করেছে। এই ১২টা কেন্দ্রে আমাদের নৌকার কোনো এজেন্ট ছিল না। এ কারণে ঈগল একচেটিয়া ওখানে ভোট কেটে নিয়ে গেল। অন্য কয়েকটি ইউনিয়নেরও তারা একচেটিয়া ভোট নিয়ে গেল। তিনি আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। হিন্দু ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দেয় নাই। নৌকা ভোটে হারেনি। সূক্ষ্ম কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা হেরেছি।
ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকার পরাজিত প্রার্থী মমতাজ বেগম বলেছেন, সিংগাইর উপজেলার বলধারা ও বায়রা ইউনিয়ন এবং সিংগাইর পৌরসভার কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটে কারচুপি করা হয়েছে। কালো টাকা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট কিনেছেন। বলধারা ও বায়রা ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীদের ভোটও ট্রাক প্রতীকে পড়েছে। এসব সিল মেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা। এসব কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অস্বাভাবিক ভোটের কারণে তাকে পরাজিত হতে হয়েছে।
নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে ভোট গণনা, ফলাফল বিবরণী প্রস্তুত ও একত্রীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ (শম্ভু) জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে তার পক্ষে একজন প্রতিনিধি গিয়ে এই অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে বলা হয়, বেআইনিভাবে ভোট গণনা, ফলাফল বিবরণী প্রস্তুত ও একত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় নৌকা প্রতীকের উপস্থিত এজেন্টদের জোর আপত্তি উপেক্ষা করা হয়েছে। আইন সঙ্গতভাবে প্রস্তুত না করায় ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপ হয়েছে বলে দাবি করেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ। অভিযোগপত্রের সঙ্গে ১৮টি ফলাফল বিবরণীর অনুলিপি জমা দেয়া হয়।
১৪ দলের প্রভাবশালী নেতা ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসনে ধরাশায়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। নির্বাচনে হারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে ভোট কারচুপি। প্রশাসন কারচুপি বন্ধ করার কোনো চেষ্টাও করেনি। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় কারচুপি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রাজশাহী-২ আসনের নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা ইসির কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নির্দেশে সব ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুবিধাভোগীর কার্ড আটকে রেখে কাঁচি প্রতীকে ভোট দিতে চাপ প্রদান করেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আমি লিখিতভাবে অভিযোগও করি। নির্বাচনের আগের রাতে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজাম-উল আজিমকে এসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যৌথবাহিনী আটক করেও নিয়ে যায়। যদিও আর সব ওয়ার্ডে সেই একই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। বাদশা অভিযোগে আরও বলেন, নির্বাচনের দিন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজস্ব বাহিনী প্রতিটি ওয়ার্ডে নৌকা প্রতীকের ভোটারদের চিহ্নিত করে তাদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করেন। ক্রমাগত হুমকি ও ভয়ভীতির কারণে ভোটের দিন ভোটাররা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেননি।
গাইবান্ধা-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী একটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ভোটে কারচুপি হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ কেন্দ্রে আমি দুই-তিনজনের বেশি ভোটার দেখিনি। আমাদের সমর্থক ভোটাররা প্রথমে সকাল ১০টার মধ্যে ভোট দিয়ে দিয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নগণ্য ভোটার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু দিন শেষে কাস্টিং যা দেখলাম, আমার মনে হয়েছে, এখানে ভোট কারচুপি হয়েছে। পরাজয়ের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সরকার আমাদের পরাজয় করতে চেয়েছিল। সরকারি দলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। প্রশাসন ও সরকার আমাদের পরিকল্পিতভাবে হারিয়ে দিয়েছে।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আবদুল কাহার আকন্দ ভোটে অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, আমি এই নির্বাচন মেনে নেইনি। আমি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করবো। এই আসনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে।
শেষ ঘণ্টায় নৌকার পক্ষে ভোট কাটার অভিযোগ: নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসনে জাল ভোটসহ অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট পুনরায় গণনা ও অর্ধশতাধিক ভোটকেন্দ্রে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমান দোলন। অনিয়মের ভিডিও ও স্থিরচিত্রসহ গতকাল আসনটির অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে নানা অনিয়মের তথ্য-প্রমাণাদি তুলে ধরে সিইসির কাছে লিখিত অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভোটের শেষ ঘণ্টায় অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম, মৃত মানুষের ভোটসহ নানা উপায়ে জালভোট প্রদান ও ভোট শেষ হওয়ার পরেও কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে নৌকার পক্ষে ভোট কাটা হয়। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোর নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রশাসনের যোগসাজশে নৌকা মার্কার পক্ষে নির্বাচনী বিধিসহ আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। অভিযোগে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের সচিবকে সরাসরি মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়েও কোনো ফল হয়নি। জালভোট পড়ার বিষয়ে একাধিক কেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারদের ঈগল মার্কার এজেন্ট ও কর্মী-সমর্থকেরা জানালে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রহস্যজনক আচরণ করেন।