DMCA.com Protection Status
title="৭

সেভেন মার্ডার কেস:৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট: ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন কমিটির সদস্যরা

2_71377নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্তে গতি এসেছে। দেশব্যাপী আলোচিত এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় র‌্যাবের তিন সদস্যকে অবসরে পাঠানো ও নজরবন্দি রাখার পর বদল করা হয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। এমনকি পুলিশ প্রশাসনেও এসেছে বড় ধরনের রদবদল। তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি না এলেও ঘটনার ১১ দিন পর তদন্ত কার্যক্রমে এসেছে জোরগতি। বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি। হত্যাকান্ডে দায়েরকৃত মামলার আসামিদের এখনও পুলিশ গ্রেফতার করতে না পারলেও সন্দেহভাজন র‌্যাব সদস্যদের যে কোনো সময় এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে। এছাড়া লাশের সঙ্গে পাওয়া আলামত নিয়েও চলছে তদন্ত। অন্যদিকে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর ও ছোট ভাইয়ের দাবি লাশের সঙ্গে পাওয়া আলামতের সঙ্গে র‌্যাব কার্যালয়ে ব্যবহৃত সামগ্রীর যথেষ্ট মিল রয়েছে।

 

তদন্ত কমিটির পরিদর্শন : সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি নারায়ণগঞ্জে লাশ উদ্ধারের স্থান ও অপহরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশে গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ শাহজাহান আলীর মোল্লার নেতৃত্বে সাত সদস্যের ওই তদন্ত কমিটি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এসে পৌঁছান। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুল কাইয়ুম সরকার ও আবুল কাশেম মোঃ মহিউদ্দিন, আইন ও বিচার বিভাগ এবং সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোস্তাফিজুর রহমান, মিজানুর রহমান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শফিকুর রহমান ও সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার।

 

পরে জেলা প্রশাসক মোঃ আনিসুর রহমান মিয়া ও সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা গাউছুল আজমকে সঙ্গে নিয়ে লাশ উদ্ধারের স্থান শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জ ও চর ধলেশ্বরী এলাকায় যান। পরে তারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় যেখান থেকে সাত জনকে অপহরণ করা হয়েছিল সেই স্থান পরিদর্শন করেন।

 

তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তের শুরুতে দরকার তাই আমরা উদ্ধারস্থলে এসেছি। আমাদের তদন্ত এখন প্রাথমিক পর্যায়ে। মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা ঠিক হবে না। তবে আমাদের যা প্রয়োজন তদন্তের স্বার্থে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন প্রত্যেককেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। এদেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাশীল। আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করব, যাতে এ ধরনের ঘটনায় যারা জড়িত তারা যেন চিহ্নিত হয় এবং ভবিষ্যতে যাতে কেউ যেন এ ধরনের ঘটনা না করতে পারে। তদন্তের প্রয়োজনে যে পর্যায়ে যেতে হয় সে পর্যায়ে আমরা যাব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ কমিটিতে দুজন বিচারক রয়েছেন, যারা অনেক চাঞ্চল্যকর মামলায় ফাঁসির রায় দিয়েছেন তারাও এ কমিটিতে রয়েছেন। সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ের প্রশ্নে তিনি বলেন, সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দেয়া হবে। আর সাক্ষীরা যেখানে নিরাপদ মনে করবেন তাদের সেখানে নিয়েই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।

 

এর আগে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্যু-মোটো ক্রিমিনাল রুল নম্বর ১৮৪০৩/১৪ মামলার ৫ মে তারিখের আদেশ মোতাবেক নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র ও আইনজীবীসহ সাত জনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ বিষয়ে ৭ মে সাত সদস্যের তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়।

 

কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে, কমিটি গণতদন্তের মাধ্যমে অপহরণের পর হত্যার সঙ্গে প্রশাসনের কোনো সদস্য বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা উদ্ঘাটন করবে। অপহরণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপহৃতদের জীবিত উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অবহেলা বা ইচ্ছাকৃত গাফিলতি ছিল কিনা তা নির্ণয় করবে। সেই সঙ্গে কমিটি সাত দিনের মধ্যে তদন্ত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করবে।

 

প্রয়োজন হলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ -এসপি : নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেছেন, সেভেন মার্ডারের তদন্তে যাকেই দরকার মনে হবে তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেফতার ও আটকের আওতায় আনা হবে। এ মামলায় আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। তবে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি।

 

বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন পুলিশ সুপার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমান, নবাগত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সুব্রত হালদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেডকোয়ার্টার) মোঃ জাকারিয়া।

 

সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ডের রহস্য সাধারণ কোনো হত্যাকান্ডের মতো এত তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরিকল্পিত হত্যাকান্ডে হত্যার পর যাতে তদন্তে কোনো সূত্র না পাওয়া যায় সে পরিকল্পনাও হত্যাকারীরা করেন। এ কারণেই এসব হত্যাকান্ডে বিপ্লবাত্মক কোনো ফল আপনাদের দিতে পারি না। তদন্ত করতে হয় শৈল্পিকভাবে। এ জন্য সময় দরকার। কারণ আমি ভুল করলে তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

তিনি আরও বলেন, আসামিদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে নরসিংদীর শিবপুর থেকে মহিলাসহ তিন জনকে আমরা গ্রেফতার করেছি।

 

সেভেন মার্ডারের ঘটনায় র‌্যাব ও সংশ্লিষ্ট বাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বা কবে হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মহিদ বলেন, তদন্তের দুটি অংশ থাকে- একটি দৃশ্যমান, যাতে খুব কম তথ্যই আপনাদের দিতে পারি। আরেকটি অংশ হচ্ছে অদৃশ্য কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, কাকে করব এর সবকিছু আপনাদের বলছি না। তবে সামনের দিনেই আপনারা দেখতে পারবেন কাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কারণ কাউকে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করব না। এছাড়া আলামত হিসেবে পাওয়া প্রত্যেকটি বিষয়ই আমরা যাচাই করে দেখব।

 

চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বদল সম্পর্কে পুলিশ সুপার বলেন, মামুনুর রশিদ ম-ল এর আগে নরসিংদীর লোকমান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিল। মূলত ওই তদন্ত আমিই করেছিলাম। মামুনুর রশিদ সেটা কম্পাইল করেছিল। সে সময় সে আমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই তাকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করে সেভেন মার্ডার মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ মামলাও আমিই তদন্ত করব। সঙ্গে তার সহযোগিতা নেব। তাই তাকে জেলা ডিবির ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ প্রশাসনে আরও রদবদল করা হবে।

 

গুমের পর নিহত চন্দন সরকারের পরিবারের পক্ষ থেকে ফতুল্লা থানায় একটি মামলা হয়েছে বলেও জানান পুলিশ সুপার।

 

আলামতের সঙ্গে মিল রয়েছে র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে ব্যবহার্য সামগ্রীর : নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত হত্যাকান্ডের লাশের সঙ্গে পাওয়া ব্যাগ, রশি ও ইটের সঙ্গে র‌্যাব-১১ এর আদমজীর কার্যালয়ে ব্যবহার্য সামগ্রীর সঙ্গে মিল রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ও তার ছোট ভাই আবদুস সালাম। বৃহস্পতিবার বিকালে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে তারা এ অভিযোগ করেন। এদিকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিনও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা দিন দিন তদন্তে উন্নতি করছেন। তদন্তের স্বার্থে যা যা করা প্রয়োজন সবকিছুই করছেন। তবে এখনই তারা সবকিছু বলতে পারছেন না।

 

অভিযোগে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে নিহত সাত লাশের সঙ্গে যেসব ব্যাগ ও রশি পাওয়া গেছে সেগুলো সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন। যে রশি দিয়ে ইটের বস্তাগুলো বাঁধা হয়েছিল সে রশি সচরাচর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। পুলিশ ও র‌্যাবে যেসব বস্তায় খাবার সাপ্লাই দেয়া হয় ওই বস্তাগুলো ওই রশি দিয়েই বাঁধা ছিল। পাট ও এক ধরনের সিনথেটিক বস্তু দিয়ে তৈরি এসব রশি সব র‌্যাব ও পুলিশ ব্যারাকেই পাওয়া যায়। র‌্যাব সদস্যরা সাধারণত বেডিং বাঁধার কাজে এসব রশি ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া যে প্রক্রিয়ায় ইটের বস্তা বাঁধা হয়েছিল তা কোনো প্রশিক্ষিত লোক ছাড়া সাধারণত এভাবে বাঁধার কথা নয়। এ প্রক্রিয়ায় বাঁধতে পারেন একমাত্র প্যারাট্রুপাড় বা প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যরাই। ইট ভর্তির বস্তায় ছাপা অক্ষরে লেখা রয়েছে চারতারা মার্কা মসুরের ডাল। নাটোরের বানেশ্বর এলাকার ঠিকানায় 'বিসমিল্লাহ ডাল মিল' নামক একটি প্রতিষ্ঠান ওই ডাল সরবরাহ করে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাপ্লাই দেয়। নজরুলের ছোট ভাই আবদুস সালাম অভিযোগ করেন, লাশের সঙ্গে উদ্ধারকৃত বস্তা র‌্যাবের কার্যালয়ে ডাল সরবরাহ করা হয়। এছাড়া রশিও তাদের কার্যালয়ে ব্যবহৃত হয়। তদন্ত টিম এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে প্রকৃত বিষয় বেরিয়ে আসবে। বস্তাগুলোয় যে ইট পাওয়া গেছে তার গায়ে লেখা রয়েছে 'এমবিবি'। এই ইট তৈরি হয় রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায়। সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের অভ্যন্তরে সিমবা ফ্যাশন নামের একটি রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনের সামনেই রয়েছে ইটের স্তূপ। এর ৫০ গজ দূরেই র‌্যাব-১১ এর ক্যাম্প।

 

এদিকে লাশের সঙ্গে উদ্ধারকৃত আলামতের পাশাপাশি ২৭ এপ্রিল দুপুরে আদালতপাড়ায় র‌্যাবের এক সদস্যের ঘোরাফেরার পর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার সমর্থকরা ওই র‌্যাব সদস্যকে কোর্ট পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। যদিও পরিচয় পাওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া যে স্থান থেকে সাতজনকে অপহরণ করা হয়, সেখানে র‌্যাবের দুটি হাইয়েস গাড়ির দীর্ঘ সময় অবস্থানের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। আর এসব কারণেই র‌্যাব-১১ এর সিও তারেক সাঈদ মাহমুদ, মেজর আরিফ, ক্রাইম প্রিভেনশনাল স্পেশাল কোম্পানির কমান্ডার লে. এমএম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!