আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও কলেজটির একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিশার বিয়ের খবর পুরনো। তবে অমর একুশে বইমেলায় মুশতাকের লেখা দুটি বই প্রকাশ নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন এ দম্পতি। তাদের নিয়ে সমালোচনাও কম চলছে না। সম্প্রতি তিশা-মুশতাক দম্পতিকে এক প্রকার তাড়া করে বইমেলা ছাড়া করেন পাঠক, ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা। এ নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন তারা। দ্বারস্থ হয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশেরও।
এদিকে, ধর্ষণের অভিযোগে মুশতাকের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এ নালিশি মামলা করেন তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। মামলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। পরে আদালত বাদীর জবানবন্দি নিয়ে মামলাটি গুলশান থানাকে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করার আদেশ দেন। সে অনুযায়ী মামলাটি নথিভুক্ত করে থানা পুলিশ।
যেভাবে জামিন পান মুশতাক-ফাওজিয়া
ওই মামলায় আত্মসমর্পণ করে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক বেগম মাফরোজা পারভীনের আদালতে ৫০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিন পান মুশতাক। পরে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন পান অধ্যক্ষ ফাওজিয়া। গত ১৭ আগস্ট মুশতাককে আগাম জামিন দেন উচ্চ আদালত। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতের শর্ত অনুযায়ী, মুশতাক ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন।
তিশাকে ক্লাস থেকে অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখাতেন মুশতাক। কিছুদিন পর মুশতাক তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় তিশাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে করেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে ঢাকা ছাড়া করবেন বলেও হুমকি দেন মুশতাক
যা বলছেন তিশার বাবা
মুশতাকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দেবেন মর্মে আদালতে সময় আবেদন করেছেন তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়ে সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ। মুশতাক আমার মেয়ের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে রেখেছেন। পরে সেগুলোকে পুঁজি করে তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন। তিনি এভাবে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন।
তিশার বাবা আরও বলেন, আমি আমার মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে নারাজি দেবো। শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো।
তবে সাইফুল ইসলামের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মুশতাক আহমেদ। তিনি বলেন, আমি তিশাকে দেশের আইন মেনে এবং ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে করেছি। তাকে বিয়ে করার জন্য কোনো জবরদস্তি করিনি।
ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলা থেকে মুশতাকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা। প্রতিবেদনে মামলা দায়েরে ‘তথ্যগত ভুল হয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয়। সেই প্রতিবেদনের ওপর গত ৩০ জানুয়ারি নারাজি দেওয়ার জন্য সময় আবেদন করেন মামলার বাদী।
সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৩ মার্চ এ মামলার শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক বেগম মাফরোজা পারভীন। নারাজির দেওয়ার আবেদনে তিশার বাবার আইনজীবী মো. ওমর ফারুক উল্লেখ করেন, মামলাটির সঠিক তদন্ত না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দেওয়া হবে।
আমার মেয়ে সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ। মুশতাক আমার মেয়ের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে রেখেছেন। পরে সেগুলোকে পুঁজি করে তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন। তিনি এভাবে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন
এ বিষয়ে তিশার বাবা বলেন, মুশতাক আমার মেয়ে তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন। তিনি আমার মেয়ের কিছু অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করছেন। ১০-১২ জন ছেলেকে ভাড়া করে আমার মেয়ের অশ্লীল ছবি তুলেছেন। মুশতাককে বিয়ে না করলে তিশার এসব ভিডিও ও ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন। আমার মেয়েকে মুশতাক বলেছেন, ‘তুমি আমাকে বিয়ে না করলে তোমার বাবা-মাকে মেরে ফেলবো’। তিশাকে বাধ্য করে বিয়ে করেছেন মুশতাক।
অভিযোগ অস্বীকার মুশতাকের
তবে খন্দকার মুশতাক বলছেন, আমি দেশের আইন মেনে এবং মুসলিম শরিয়া মোতাবেক তিশাকে বিয়ে করেছি। বিয়েতে তিশাকে কোনো জবরদস্তি করিনি। সার্টিফেকেট অনুযায়ী তিশার বয়স যখন ১৮ বছর এক মাস তখন আমি তাকে বিয়ে করেছি। তখন তিশার প্রকৃত বয়স ১৯ বছর। আমার বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁয়ে অপহরণের অভিযোগে যে মামলা করা হয়েছিল তা শেষ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, তিশা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে, সে স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছে। তার বাবা-মা এ বিয়ে মেনে নিতে পারবেন না বলেই মামলা করেছেন।
স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুশতাকের সঙ্গে পরিচয় হয় তিশার। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে ঘুরতে যেতেন ভিকটিম। স্কুলের অধ্যক্ষ বা অন্য কোনো শিক্ষক বিষয়টি জানতেন না বলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুশতাক বলছেন, আমি দেশের আইন মেনে এবং মুসলিম শরিয়া মোতাবেক তিশাকে বিয়ে করেছি। বিয়েতে তিশাকে কোনো জবরদস্তি করিনি। সার্টিফেকেট অনুযায়ী তিশার বয়স যখন ১৮ বছর এক মাস তখন আমি তাকে বিয়ে করেছি। তখন তিশার প্রকৃত বয়স ১৯ বছর
কী আছে পুলিশি প্রতিবেদনে
প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ভিকটিম তিশা আদালতে হাজির হয়ে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি জানান, চলতি বছরের (২০২৩ সালের) ২৫ মার্চ তিনি স্বেচ্ছায় ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে খন্দকার মুশতাক আহমেদকে বিয়ে করেন। বিজয়নগর কাজী অফিসে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয়। ভুক্তভোগী কলেজছাত্রীর বয়স ১৮ পূর্ণ হলে আসামি মুশতাক তাকে বিয়ে করেন। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে কেউ কোনো ধরনের প্ররোচনা দেননি বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
সাক্ষ্য-প্রমাণ মিললে মামলাটি ফের চলবে
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, বাদী বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষকে অভিযোগ করেন তার মেয়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। এ অভিযোগ পেয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ভুক্তভোগীকে মৌখিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেসময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন ভিকটিম। ভবিষ্যতে এভাবে আর যাবেন না বলেও স্বীকারোক্তি দেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সবকিছু বিবেচনায় আসামি খন্দকার মুশতাক ও অধ্যক্ষ ফাওজিয়ার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সেংশোধনী-২০০৩) এর ৯(১)/৩০ ধারায় অপরাধ প্রামাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তবে ভবিষ্যতে মামলার ঘটনার বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
২০২৩ সালের ১ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক বেগম মাফরোজা পারভীনের আদালতে এ মামলা করেন ভুক্তভোগীর বাবা। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন। এরপর গুলশান থানা মামলাটি এজাহারভুক্ত করে।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, তার মেয়ে (ভুক্তভোগী) মতিঝিল আইডিয়ালের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আসামি মুশতাক বিভিন্ন অজুহাতে কলেজে আসতেন এবং ভুক্তভোগীকে ক্লাস থেকে প্রিন্সিপালের কক্ষে ডেকে নিতেন। খোঁজখবর নেওয়ার নামে আসামি ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন। কিছুদিন পর আসামি মুশতাক ভুক্তভোগীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে করেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে ঢাকা ছাড়া করবেন বলেও হুমকি দেন মুশতাক।
এজাহারে আরও বলা হয়, এ ধরনের আচরণের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষকে (২ নম্বর আসামি) ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন ভুক্তভোগীর বাবা। তিনি (অধ্যক্ষ) ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে আসামি মুশতাককে তার কক্ষে ডাকেন। পরে ভুক্তভোগীকেও ক্লাস থেকে ডেকে এনে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুশতাককে সময় ও সঙ্গ দিতে বলেন।
এ বিষয়ে বাদী ২ নম্বর আসামির (অধ্যক্ষ) কাছে প্রতিকার চাইতে গেলেও তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি। বরং আসামি মুশতাককে অনৈতিক সাহায্য করতে থাকেন। উপায় না পেয়ে বাদী গত ১২ জুন তিশাকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িতে নিয়ে গেলে আসামি মুশতাক তার লোকজন দিয়ে তাকে অপহরণ করেন। এরপর বাদী জানতে পারেন আসামি মুশতাক একেক দিন একেক স্থানে রেখে তিশাকে অনৈতিক কাজে বাধ্য এবং যৌন নিপীড়ন করছেন।