ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে মিঠামইনের জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রামের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়কে আলপনা আঁকার পক্ষে বিপক্ষে আবস্থান নিয়ে কার্যত দুই ভাগ হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যেখানে বেশিরভাগ মানুষ এর সমালোচনা করছে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। আবার আরেক পক্ষ যুক্তি দিচ্ছে, এই আলপনার সামান্য ক্ষতি নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। এসব নিয়ে ফেসবুকে তর্ক বিতর্কে মেতেছে মানুষজন।
একজন বিশাল এক পোস্ট দিয়ে এই আলপনা পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা পয়েন্ট আকারে তুলে ধরেছেন। তার পোস্টের মূল বক্তব্য হলো ‘মিঠামইনের ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে আলপনা করতে ৬ লক্ষ বর্গফুট জায়গা ব্যবহৃত হয়েছে, রং লেগেছে প্রায় ১০ হাজার লিটার। ১০ হাজার লিটার কেমিক্যাল হাওড়ের মাটি-পানিতে মিশলে; জীবপ্রকৃতির কি পরিমাণ ক্ষতি হবে, ভাবা যায়?’
তিনি তার পোস্টে রঙের উপাদান হিসেবে কি থাকে সেটিও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ‘হলুদ পিগ্মেন্ট হিসেবে থাকে আরসেনিক সালফাইড। কালো পিগ্মেন্ট কার্বন। লাল লেড অক্সাইড – যা মানুষ ও গবাদি পশুর লেড পয়জনিং এর কারন হবে। বিষয়টি বোঝে ওঠার ও চিকিৎসা করার আগেই রোগী শেষ হয়ে যাবে বলে লিখেছেন সেই পোস্ট দাতা।’
আবার এই ধরনের পোস্টের পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন অনেকেই। এই যেমন অনেকে বলছেন,
‘পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গার কাজে শত শত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে টক্সিক জাহাজের সংস্পর্শে এসে, তার প্রতিবাদ করেছেন কখনো? কাপড়ের রঙ মেশানো হয় খাদ্যে ও ফলের জুসের মধ্যে। তার প্রতিবাদ করেছেন কখনো? বুডিগঙ্গা দূষণের প্রতিবাদ করেছেন কখনো? এখন ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে তুরাগ দূষিত করা হচ্ছে, এবং সেটা প্রতিদিন টন টন বর্জ্য ও রঙ।’
আলপনা পক্ষে যুক্তি দিয়ে অনেকেই একটি বিষয় লিখছেন, ‘নববর্ষের আলপনা করা রঙে প্রকৃতি দূষণ হয় না। জেনে রাখুন চারুকলার ছাত্ররা নির্বোধ নয়, তারা water colour ব্যবহার করে, সেটা টক্সিক নয়।’
ফেসবুকে যারা আলপনার পক্ষে এসব যুক্তি দিচ্ছেন সেগুলোর বিপক্ষে আবার পাল্টা যুক্তি দাড় করাচ্ছেন। একজন লিখেছেন, ‘দখল, দূষণ, কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে যেখানে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল বিপন্ন হচ্ছে, সেখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটারের আলপনায় হাওরের আর কতটুকুই বা ক্ষতি হবে? যুক্তি হিসেবে এটি খারাপ না। কিন্তু ডাকাতি ঠেকানো যাচ্ছে না বলে চুরির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না—সেটিও কোনো কাজের কথা নয়।’
যারা আলপনা পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তাদের যুক্তি হচ্ছে সৌন্দর্যের জন্য সামান্য ক্ষতি মেনে নেওয়া উচিত। এই যেমন একজন লিখেছেন, ‘হঠাৎ করে আলপনার রঙ নিয়ে বাঙালি বিশাল পরিবেশ সচেতন হয়ে গেছে। ইন্ডাস্ট্রির রঙের বর্জ্যে খালবিল পরিবেশ দূষিত হচ্ছিল কোথায় ছিলেন? দেশের ঘুষ দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ নাই, শিক্ষায় বরাদ্দ কম নিয়ে প্রতিবাদ নাই, কলকারখানার বর্জ্যে দেশের নদনদী খালবিল দূষিত হয়ে মাছসহ অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হওয়া নিয়ে প্রতিবাদ নাই অথচ সামান্য একটু আলপনার রঙে দূষণ নিয়ে চিন্তায় ঘুম নাই।’
তবে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে না সেটার পক্ষে যুক্তি কেউই দেখাতে পারেননি। উল্টো বেশিরভাগই লিখেছেন কিভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে হাওড়ের মাছ। একজন পোস্ট করেছেন, ‘পেইন্টে প্রচুর পরিমাণ মার্কারি ব্যবহার হয় যা ফানজিসাইড হিসেবে ব্যবহার হয় যা মানুষের নার্ভাস সিস্টেম, কিডনি ও ব্রেইন এর মারাত্নক ক্ষতি করে। গর্ভবতি মা ও শিশু সবচেয়ে ভালনারেবল। আরেকটা মারাত্নক হেবি মেটাল ব্যবহার হয় ক্যাডমিয়াম যা কিডনি ডেমেজ ও ক্যান্সারের কারন। ক্রোমিয়াম, এসবেটস, টাইটানিয়াম এর কথা আর নাই বললাম।’
দুই পক্ষের যুক্তি তর্ক ব্যাখ্যা করে একজন উপসংহার টেনেছেন। ফেসবুকে সেই ব্যক্তি তার লম্বা পোস্টের এক জায়াগায় লিখেছেন, ‘সহজে যদি একটা উপসংহার টানা হয় তাহলে বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে কিশোরগঞ্জে আকা ১৪ কিলোমিটারে আলপনায় ব্যাবহৃত সাড়ে ৯ হাজার কেজি রঙের কারনে ওই হাওড় এর ইকোসিস্টেম বড় ধরনের ক্ষতি সম্মুখীন হতে চলেছে। এর ফলে হাওড়ের বিভিন্ন জলীয় প্রানী, এসব প্রানীর উপর নির্ভরশীল মানুষ, হাওরের পানিকে পানির উৎস হিসাবে ব্যাবহার করা মানুষ বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে চলেছে যা পরিবেশ, অর্থনীতি উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হবে।
চাইলেই এই আলপনা স্থান এমনভাবে নির্ধারিত করা যেতো যেনো ইকোসিস্টেমে এইসব ভারী ধাতু প্রবেশ না করে। ব্যবস্থাপকদের অদূরদর্শীতা স্পষ্ট এখানে। শিল্প আর ঐতিহ্যের সম্মানে ব্যবস্থাপকদের এই খেয়ালিপনা মোটেই সমর্থনযোগ্য না যেটা বহু প্রগতিশীল মানুষকে করতে দেখছি। তবে এটাও সত্য, সারাবছর বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রের অবব্যবস্থাপনায় আমাদের যে ক্ষতি হয় তার কাছে এইটা তেমন কিছুই না।’
আয়োজকরা বলছে, এটি বিশ্বের দীর্ঘ আলপনা। এশিয়াটিক এক্সপেরিয়েন শিয়াল মার্কেটিং লিমিটেড, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড যৌথভাবে আলপনাটি এঁকেছে। প্রায় ৬৫০ জন শিল্পী তিনদিন ধরে আলপনাটি এঁকেছেন।