ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিল্টন সমাদ্দার আর আফজাল খান। একজন দেন অসহায় শিশু-বৃদ্ধকে আশ্রয়। অন্যজনের কাছে আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসা পায় পশু-পাখি। দু’জনই ‘প্রাণ’ বাঁচানোর ফেরিওয়ালা। ফলে ‘শুভচিন্তক’ হিসেবে তারা মানুষের মনে ঠাঁই নেন। মিল্টন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামে আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। আফজাল ‘রবিনহুড– দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ার’ নামে সংগঠনের হর্তাকর্তা। তবে সমাজসেবার আড়ালে তারা যে নানা অপকর্মে নাম লিখিয়েছেন, তা সর্বসমক্ষে আসে কিছুদিন আগে।
চিকিৎসক সেজে মৃত্যুসনদ জালিয়াতি, মানব পাচার ও আশ্রিতদের নির্যাতনের অভিযোগে এরই মধ্যে মিল্টনের নামে মিরপুর থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। গত বুধবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার জালিয়াতির মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
মিল্টন অপকর্ম করে আইনের আওতায় এলেও ‘রবিনহুড’ পরিচিতি পাওয়া আফজাল খানের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, নির্যাতন, কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সুস্থ কুকুর-বিড়ালের পা ভেঙে আবার উদ্ধারের নাটক সাজানোর মতো অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ কয়েকদিন ধরে তাঁকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।
মিল্টনের অর্থ পাচারের খোঁজে পুলিশ
মানবসেবার আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দারের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজে ডজনখানেক নম্বর দিয়ে টাকা হাতানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের অনুদানের টাকা পাচার করেছেন তিনি। এতে তাঁর নামে মানি লন্ডারিং আইনে আরও মামলা হবে। ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হবে। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়, তবে তিনি ভয়ংকর অপরাধ করেছেন।
মিল্টনের বিরুদ্ধে আরও কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ নিয়ে এলে মামলা হবে। তিনটির মধ্যে প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। এ ছাড়া মানব পাচার ও টর্চার সেলে মারধরের অভিযোগে আরও দুটি মামলা করেন দুই ভুক্তভোগী। এসব মামলায় তাঁর সহযোগী হিসেবে স্ত্রী এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কিশোর বালাসহ অচেনা আরও ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে বুধবার রাতে মিরপুর থেকে মিল্টনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। ওই রাতেই ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ভয়ংকর।
ডিবি সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের সনদ ছাড়াই রাতে লাশ দাফন করত মিল্টনের প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সিটি করপোরেশনের সিল ও সই নকল করে মৃত্যুসনদ তৈরির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ বা শিশুকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করার ছবি-ভিডিও শেয়ার করে আলোচনায় আসা মিল্টনকে নিয়ে গত কয়েকদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনিয়মের খবর প্রকাশ হতে থাকলে ফের আলোচনা শুরু হয়। এরপরই তৎপর হয় পুলিশ।
এ ব্যাপারে গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করব। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। তবে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে কেউ মামলা করলে আইনানুযায়ী তাঁকেও গ্রেপ্তার করব।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, মিল্টন তাঁর ফেসবুক পেজে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশন এবং মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এবং শেষটি কোম্পানি।
এসব প্রতিষ্ঠানের পেজে সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ ও আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের অনেক ছবি-ভিডিও শেয়ার করা হয়। বিভিন্ন সময় এ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনের ভিডিও পোস্ট করেন তিনি। অনেক ভিডিওতে আশ্রমের বাসিন্দা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মা-বাবা ও শিশুদের সন্তান সম্বোধন করতেন মিল্টন। এসব ভিডিওর পাশাপাশি তাঁর ফেসবুক পেজে ১০টির বেশি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দেওয়া রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে সংগৃহীত অনুদানের টাকাতেই চলে এসব প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, মিল্টন বরিশাল উজিরপুরের বড়াইকাঠি এলাকার ছবি সমাদ্দারের ছেলে। তাঁর বাবাকে মারধরের অভিযোগে এলাকাবাসী তাঁকে পিটিয়ে এলাকা থেকে বের করে দেয়। এরপর শাহবাগে ওষুধের দোকানে কাজ করতেন। সেখানে ওষুধ চুরির অভিযোগে চাকরি হারান। পরে মিল্টন রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা খ্রিষ্টান হাসপাতাল থেকে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন বলে দাবি করেন। পরে তিনি এক নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রয়কেন্দ্র।
মিল্টনের দুটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে জানিয়ে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, তাঁর একটি আশ্রয়কেন্দ্র মিরপুরে, অন্যটি সাভারে। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক রয়েছে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪০ জনের বেশি নেই। তিনি যেখানে অপারেশন থিয়েটার (অস্ত্রোপচার কেন্দ্র) স্থাপন করেছেন, সেখান থেকে কিডনি বিক্রি করেছেন কিনা, সেই অভিযোগটিও তদন্ত করা হবে। তিনি ৯০০ লাশ দাফন করলেও ৮০০ লাশের নথি দেখাতে পারেননি। পাশের মসজিদে যারা লাশের গোসল দিয়েছেন, তারা অনেক লাশের কিডনির পাশে কাটা ও রক্তের দাগ পেয়েছেন।
প্রাণিপ্রেমের আড়ালে আরেক আফজাল খান
‘আমি ওনার ক্লিনিকে বিড়ালের চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলাম। পরে ফেসবুকে ওনাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটা ভালো রিভিউ দিই। এর পর তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিচয়ের সূত্র ধরে একদিন খিলগাঁওয়ে তাঁর অফিসে যেতে বলেন। একই ভবনের নিচতলায় ক্লিনিক, ওপরে তাঁর বাসা–অফিস এবং ছাদে উদ্ধার করা পশুপাখি রাখা হয়। সেদিন (২০২২ সালের ৫ জুন) বিকেল ৩টার দিকে ক্লিনিকে গেলে তিনি আমাকে ওপরে যেতে বলেন। ছাদের পশুপাখি দেখাবেন ইত্যাদি বলেন। পরে বাসায় গেলে আমাকে প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। আমি তখন অসুস্থ ছিলাম, তবু আমার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।’ রবিনহুডখ্যাত আফজাল খানের বিরুদ্ধে এভাবেই ধর্ষণের অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থী।
তিনি জানান, ধর্ষণের পর আফজাল হুমকি দেন– কাউকে কিছু বললে তোমারই ক্ষতি হবে। আমার সিঁড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে। ফুটেজে দেখা যাবে, তুমি স্বেচ্ছায় আমার বাসায় এসেছ। তোমারই বদনাম হবে। তাছাড়া পুলিশ প্রশাসনের লোক আমার ঘনিষ্ঠ। তুমি কিছুই করতে পারবে না। ফলে তরুণী আর কোথাও এ বিষয়ে অভিযোগ করার সাহস পাননি।
অবশ্য এমন ঘটনা একা ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে হয়েছে, তা নয়। আফজালের প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময় পোষা প্রাণীর চিকিৎসা নিতে যাওয়া বা স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই নানা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের মধ্যে একাধিক নারী ধর্ষণ এবং কয়েকজন শ্লীলতাহানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। তেমনই একজন কুমিল্লা সদরের এক তরুণী, যিনি একসময় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জানান, আফজাল বিভিন্ন সময়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভিডিওকল দিয়ে আপত্তিকর প্রস্তাব দিতেন। এ ছাড়া হুটহাট বাজেভাবে জড়িয়ে ধরতেন। তরুণী ক্ষিপ্ত হলে বলতেন– ‘আরে আমরা তো বন্ধু।’
সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ভিডিও ধারণ ও ছবি তোলায় যুক্ত একজন জানান, স্বেচ্ছাসেবী হতে আসা মেয়েদের দিয়ে মডেলদের মতো করে ছবি তুলিয়ে রাখতেন আফজাল। পরে সেগুলো দিয়ে তাদের জিম্মি করার চেষ্টা চালাতেন। এতে অনেকে ভয় পেয়ে তাঁর অনৈতিক কাজ মুখ বুঁজে সহ্য করে যেত।
একাধিক সাবেক কর্মী অভিযোগ করেন, পশুপাখি ভালোবাসার ভান করলেও আসলে তিনি টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে প্রাণীকে ব্যবহার করতেন। এমনকি নিজেই সুস্থ কুকুর-বিড়ালের পা ভেঙে রাস্তায় ফেলে আসতেন। পরে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে সেগুলো উদ্ধারের নাটক করতেন।
খিলগাঁওয়ের এক নারীর দাবি, সুলতান নামের একটি কুকুরকে আফজাল নিজেই ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলেন। এ ছাড়া তাঁর দুটি সুস্থ কুকুরছানা ছিল। একদিন দেখা যায়, একটার চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। ওই নারীর জেরার মুখে এক সময় তিনি স্বীকার করেন– তাঁর কাছে টাকা ছিল না, তাই এমনটা করেছেন।
ফাতিমা আক্তার ইয়ামুন নামে এক শিক্ষার্থী তাঁর পোষা বিড়ালকে ভুল চিকিৎসায় হত্যার অভিযোগ করেন ভেটেরিনারি কাউন্সিলে। সেখানে তদন্তে দেখা যায়, ওই ক্লিনিকে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না।
মালয়েশিয়া প্রবাসী মুক্তা সুলতানা অভিযোগ করেন, সংগঠনে যুক্ত হওয়ার ফি হিসেবে তাঁর কাছ থেকে প্রথমে ২ লাখ টাকা নেওয়া হয়। এর পর এটাসেটা কেনার কথা বলে নানা অঙ্কের টাকা নেন। এক পর্যায়ে টাকা দিতে না পারলে আফজাল তাঁর নম্বর ব্লক করে দেন।
আরেক সাবেক কর্মী জানান, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রবিনহুডকে বিপুল অর্থ সহায়তা দিত। সেসব টাকার বেশির ভাগ আফজাল ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাতেন।
গত ডিসেম্বরে হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার থেকে পোষা পাখি উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবক তাসফিয়ান ইসলাম আতিফ। ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের এ ছাত্রের মায়ের অভিযোগ, তাঁর ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে আতিফ তাঁকে জানিয়েছেন, জোর করে তাঁকে উদ্ধারে পাঠানো হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ফোনে আফজাল খান বলেন, কিছু মানুষ ঈর্ষা থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সব অভিযোগই মিথ্যা। আমি কলকাতায় এসেছি, ফিরে বিস্তারিত বলব।