ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকায় ব্যাপক আলোচিত ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টায় ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করেন। তবে তিনি ব্যর্থ হন। ওই নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করায় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি।
এরপর আসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এসময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান ডব্লিউ মজিনা। সে সময় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমান সুযোগ নিশ্চিতে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করেন তিনি। তার সে দৌড়ঝাঁপে সরকারের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তার কঠোর সমালোচনা করতেন। এমনকি তার ওপরও হামলারও ঘটনা ঘটে ঢাকায়।
সর্বশেষ সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের কথা জানান দেন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হাস দিনরাত পরিশ্রম করেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বও সৃষ্টি হয় মূলত নির্বাচন নিয়ে। যার পেছনে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেনদরবার করেন। যদিও ভারতের পরোক্ষ প্রভাবে শেষ পর্যন্ত তার সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
এদিকে দুই পূর্বসূরী কূটনীতিকের ন্যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকার কারণে পিটার ডি হাসকের সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। আওয়ামী লীগের নানা পর্যায় থেকে তাকে হত্যারও হুমকি দেওয়া হয়। যে কারণে এই নির্বাচনের আগে সারা দেশে পরিচিতি পান মার্কিন এই কূটনীতিক।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ডেভিড স্লেটন মিলকে। সংগত কারণে এখন ডেভিড মিলও আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন। তাকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানামুখী আলোচনা। পিটার হাসের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কিন প্রশাসন কেমন কূটনীতিককে ঢাকায় পাঠায় সেটি দেখতে মুখিয়ে রয়েছে ঢাকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল।
ডেভিড মিলকে ঢাকাস্থ দূতাবাস প্রধান হিসেবে গত সপ্তাহে মনোনয়ন দেয় বাইডেন প্রশাসন। রাষ্ট্রপতির এই মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট শুনানিতে অনুমোদন পাওয়ার পর চূড়ান্ত হবে। নিয়োগ চূড়ান্ত হলেই বর্তমানে চীনে থাকা এই কূটনীতিক তার নতুন কর্মস্থলে এসে যোগ দিবেন।
মার্কিন রীতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট কূটনীতিকের নামের মনোনয়ন ঘোষণা করেন। এরপর এটি দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে পাঠানো হয়। সেখানে শুনানির পর যোগ্য মনে হলে তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে সেই দেশে পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্টের মনোনীত এ কূটনীতিক এর আগেও ঢাকায় কাজ করেছেন।
হোয়াইট হাউসের তথ্য বলছে, ডেভিড মিল প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় মার্কিন মিশনের উপপ্রধান ছিলেন। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি, ভৌগোলিক গুরুত্ব ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ব থেকেই ওয়াকিবহাল। ডেভিড মিল বর্তমানে চীনে কর্মরত। তিনি সেখানকার রাজধানী বেইজিংয়ের মার্কিন দূতাবাসের অন্তবর্তীকালীন চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২২ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই পদে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি।
ডেভিড মিল ২০১৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বিষয়ক ব্যুরোর বাণিজ্য নীতিবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হন। এর আগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নীতি ও বাস্তবায়ন বিষয়ক পরিচালক ছিলেন।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন প্রশাসন। ওই নিষেধাজ্ঞার বহর নির্বাচনের আগে আরো বাড়তে পারে বলে সে সময় রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল। যদিও নিষেধাজ্ঞার পরিধি আর বাড়েনি।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে তাদের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে কাজে লাগায়। বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কার্যকরের জন্য কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল। যা দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের আওতাধীন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন রাষ্ট্রদূত একজন নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ হওয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি সাবেক তিন রাষ্ট্রদূতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন বলে মনে করেন অনেকে।
মার্কিন এ কূটনীতিক তারও আগে বিদেশ মিশনে ছিলেন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসির ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটের লিডারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট স্কুলের সহযোগী ডিন, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে মার্কিন দূতাবাসের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা এবং অর্থনৈতিক ব্যুরোর আর্থিক বিষয়ক অফিসের উপপরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। ডেভিড মিলের একাধিক দেশে কূটনীতিক কার্যক্রমে ভূমিকা রয়েছে।
হোয়াইট হাউসের তথ্যানুসারে, তিনি চীন, হংকং, তাইওয়ান, গিনি এবং ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক কার্যক্রমে ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯২ সালে তিনি ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন এবং মিনিস্টিার-কাউন্সিলর পদে অধিষ্ঠিত হন। ফরেন সার্ভিসের আগে তিনি মার্কিন টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি ‘স্প্রিন্ট টেলিকমিউনিকেশনের কর্পোরেট ফাইন্যান্স পদে কর্মরত ছিলেন।
ডেভিড মিল ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা। তিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির আইজেনহাওয়ার স্কুল থেকে এমএস, টুলেন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ করেছেন। তিনি ডেপুটি চিফ অফ মিশন হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য বেকার-উইলকিন্স পুরস্কার লাভ করেন। ইংরেজির বাইরে তার চীনা, ইউক্রেনীয় এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতা রয়েছে।