DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

রিমালের ছোবল ১৯ জেলায় দীর্ঘ তাণ্ডবে বড় বিপর্যয়

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ উপকূলে দীর্ঘ সময় ঘূর্ণি বয়ে দিয়ে থেমেছে রিমাল। তবে ঝড় বিদায় নিলেও রেখে গেছে ক্ষতের দাগ। ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্বল হারিয়ে দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষ। কীভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। রিমাল তার ঘূর্ণিতে যতটা না ঘায়েল করেছে, এর চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ঝড়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টির কারণে। সব মিলিয়ে উপকূলের অর্ধকোটি মানুষের দুই চোখে এখন অমাবস্যা।

সরকারি হিসাবে দেশের অন্তত ১৯ জেলার মানুষকে কাঁদিয়েছে রিমাল। কেড়ে নিয়েছে ১৬ প্রাণ। বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, গাছপালা। গ্রামীণ সড়ক আর বেড়িবাঁধ ভেঙে একাকার। পানির নিচে ভাসছে গ্রামের পর গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, মাঠের ফসল। ‘বিপদের ঢাল’ সুন্দরবনও আঘাত থেকে বাঁচেনি। বিদ্যুৎ নেই; নেই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। ঘরে নেই খাবার। সবচেয়ে বেশি বিপদে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। দুই দিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার খেয়ে টিকে আছে মানুষ। সব মিলিয়ে উপকূলে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়। এমন বিপন্ন মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত সরকারি-বেসরকারি মানবিক সহায়তা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিগগিরই ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।


এদিকে গতকাল দিনভর বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ায় অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশ। ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ডুবেছে চট্টগ্রাম। ১৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ঢাকা নগরী হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। তবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করছে নগরজীবন। খুলে দেওয়া হয়েছে বিমানবন্দর, চালু হয়েছে সমুদ্রবন্দরও। রিমালের প্রভাবে দেশজুড়ে যে বর্ষণ চলছে, তা আরও ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কাল বুধবার থেকে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রিমালে কেমন ক্ষতি
গেল রোববার আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় টানা ভারী বৃষ্টি থাকায় কাঁচা ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন দুর্যোগবিষয়ক দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা।


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান গতকাল ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে জানান, এখন পর্যন্ত খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলার ১০৭ উপজেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলাগুলো হলো– সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জেলায় নগদ সহায়তার ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ৯ জেলায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীতে জোয়ারে ভেসে গিয়ে একজন এবং গাছ পড়ে দু’জন মারা গেছেন। সাতক্ষীরাতেও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বরিশালে ভবনের দেয়াল ধসে দু’জন, গাছচাপায় একজন মারা গেছেন। ভোলায় ঝড়ে ঘর ও গাছচাপা পড়ে প্রাণ গেছে তিনজনের। খুলনায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক পথচারী মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অতি ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের মধ্যে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় খালে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে দমকা হাওয়ায় বিধ্বস্ত একটি টিনশেড ঘরে চাপা পড়ে পুষ্প আক্তার (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কুষ্টিয়ার মিরপুরে টিনের চালার নিচে পড়ে এক বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সড়কে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে লিজা নামে এক পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। রিমালের প্রভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মারা গেছেন ছয়জন।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রাথমিক হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের ১০টি জেলার ৮৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ লাখের বেশি শিশু এবং প্রায় ৪৩ লাখ নারী রয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭ শতাংশ ফসল ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মাছের ঘেরেরও। তবে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনও হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় রিমালে বিতরণ লাইন লন্ডভন্ড হওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দেশের দুই কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বলছে, বিদ্যুৎ না থাকায় ৬৪ জেলার ২২ হাজার মোবাইল সাইট (টাওয়ার) অচল হয়ে পড়েছে, যা মোট সাইটের ৪৮ শতাংশের বেশি।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির খুব বেশি দৃশ্যমান হিসাব পাওয়া যাবে না। যেমন সেতু ভেঙে পড়েছে, গাছ উপড়ে গেছে বা বাড়িঘর ধসে গেছে। কারণ, এ ঝড়ে মূল ক্ষতি করেছে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় চলা টানা ভারী বৃষ্টি। এ বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, এ মুহূর্তে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করা জরুরি। যাদের ঘরের খাবার নষ্ট হয়েছে, তাদের কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। সুপেয় পানি সরবরাহ করতে হবে। এসব অসহায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তাই পুনর্বাসন কার্যক্রম হতে হবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় যারা ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা, তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সমস্যা হবে। তাই ঋণের কিস্তি নেওয়া আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দ্রুত সেগুলো মেরামত করতে হবে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা যেহেতু বেড়িবাঁধের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল, সেহেতু বেড়িবাঁধ টেকসই হওয়া আবশ্যক।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব তৈরি করে যেখানে যে পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা দরকার, তা পাঠিয়েছি। তবে স্থানীয় পর্যায় থেকে আরও বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সহায়তা দেওয়া হবে।

‘বিপদের ঢাল’ সুন্দরবন এবারও ক্ষতবিক্ষত
বহু শক্তিশালী ঝড় সামলে নিয়েছিল সুন্দরবন। জানমাল রক্ষায় ‘ঢাল’ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুবজ সেই অরণ্য এক রিমালের আঘাতে এবারও ক্ষতবিক্ষত। জলোচ্ছ্বাসে বনের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত। ভেসে গেছে মিষ্টিপানির অধিকাংশ পুকুর। এ ছাড়া বনের কাঠের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সুন্দরবন-পূর্ব বিভাগের বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা ও দুবলারচর থেকে দুটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে বলে সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, যেহেতু বনের সব জায়গা তলিয়ে গেছে, এতে বন্যপ্রাণীর বেশ ক্ষতি হওয়ার কথা। সমুদ্র-তীরবর্তী দুবলারচর ও কটকা বন বিভাগের কার্যালয়ের জেটি স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বনকর্মীর থাকার ঘরের জানালার কাচ, মিষ্টিপানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সুপেয় পানির ট্যাঙ্ক, সোলার প্যানেল উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে বনের কটকা এলাকার পুকুর বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে।

সুন্দরবন-পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। তবে এবার ঝড়ের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!