সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়ার পর নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নিবন্ধনকৃত অন্যান্য দলের তালিকার সঙ্গে জামায়াতের নাম এখনো রয়েছে।তবে ৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন পরবর্তি পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারের জামাতের প্রতি নমনীয় নীতির অংশ হিসাবে এটা করা হয়ে থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কিন্তু এতে দেশের সুশীল সমাজ, আইন বিশেষজ্ঞগণ বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, হাইকোর্টের রায় আপীল বিভাগ কর্তৃক স্থগিত না হলে, হাইকোর্টের রায়কেই আইনানুগ সিদ্ধান্ত গণ্য করে রায়ের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে।
কোন অজুহাতেই জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধনভুক্ত দলের তালিকায় রাখার সুযোগ নেই। এমন কিছু করা হলে তা হবে আদালতের রায়ের লক্ষণ। যা আদালত অবমাননার শামিল হিসেবে গণ্য হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু বিষয়টি আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নিবন্ধনকৃত অন্যান্য দলের সঙ্গে জামায়াতের নামও থাকতে পারবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যদি তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয় তা হলে কেউ বুঝতে পারবে না, কি কারণে নাম বাদ দেয়া হয়েছে। নাম রেখে নিচে হাইকোর্ট কর্তৃক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে সে বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এতে করে জনগণের কাছে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আইন কমিশনসহ সিনিয়র আইনজীবীদের অভিমত যেহেতু হাইকোর্ট থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হয়েছে, উচ্চ আদালত তা স্থগিত করেনি। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তালিকায় এখন আর জামায়াতের নাম রাখাটা আইন বহির্ভূত কাজ। বিষয়টি আদালত অবমাননার শামিল। এখন উচ্চ আদালতে বিষয়টি নজরে আনা উচিত। কারণ অনেক অনিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলও আছে তাদের নাম ওয়েবসাইটে নেই। তাদের নাম দিয়ে পিছনে যদি লেখা হয় এগুলো অনিবন্ধনকৃত দল। জামায়াতের বেলাতেও এমনটিই হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, তালিকায় জামায়াতের নাম দেয়ার পর নিচে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে করে জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ কেউ কেউ অভিমত দিয়েছেন, যতক্ষণ আপীল বিভাগে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হবে ততক্ষণ তালিকায় জামায়াতের নাম থাকতে বাধা নেই।
তবে নির্বাচন কমিশন যেভাবে নিচে হাইকোর্ট কর্তৃক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেইভাবে আরও লেখা উচিত ছিল বিষয়টি এখন আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজ বলেছেন, সবাইকে হাইকোর্টের আদেশ মানতে হবে। জামায়াতে ইসলামী একটি নিবন্ধনকৃত দল ছিল। হাইকোর্টের আদেশে নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। হঠাৎ করে ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেললে কেউ বুঝতে পারবে না, কি কারণে মুছে ফেলা হয়েছে।
তালিকায় নাম দিয়ে নিচে লিখে দেয়া হয়েছে, ‘মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রিট পিটিশন নং ৬৩০/২০০৯-এর ওপর ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখে প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।’ এর ফলে সবাই জানুক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১ আগস্ট উন্মুক্ত আদালতে তিন বিচারকের বেঞ্চ সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ২ নবেম্বর তার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ঐতিহাসিক এ রায় দেন। আদালত রায়ে বলে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ রায় প্রদান করা হলো। হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীকে সমালোচনা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর মামলার পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে গেছেন।
যা আদালতে যুক্তিতর্কের নির্বাচন কমিশন এভিডেভিট করে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ প্রসঙ্গে আইনজীবীগণ বলেছেন, যখন কোন আইনজীবী তার মক্কেলের স্বার্থের বাইরে কাজ করে তা অবশ্যই সেটা পেশাগত অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এই মামলার রায়কে আমাদের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নতুন নজির স্থাপন করেছে। যা পরবর্তীতে এ জাতীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রিন্সিপাল হিসেবে ব্যবহার করা সুযোগ হবে।