ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মাগুরা জেলা শাখার সভাপতি আব্দুর রহিমকে গ্রেপ্তারের পর নেওয়া হয় ঢাকার মিন্টু রোডে অবস্থিত পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখানে নির্যাতনের পর বিদ্যুতায়িত করে ডিবির তৎকালীন ‘পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ গোলাম সাকলায়েনের নেতৃত্বাধীন একটি দল। যিনি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমণির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে এখন চাকরি হারাচ্ছেন।
ঘটনাটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের পর পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্দুর রহিম এ তথ্য জানান।
তবে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও ২০২৩ সালে একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জেলা ছাত্রদলের এ নেতা। তবে এক্ষেত্রে আদালতে উপস্থাপনের সময় তার দেহে যাতে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখাতে না পারেন সে কারণে দেওয়া হয় ইলেক্ট্রিক শক—অভিযোগ করেছেন তিনি। দ্বিতীয়বারের ঘটনাটি ঘটে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানায়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দল দমনে ভূমিকা পালন করা অনেক কর্মকর্তাকে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পুরস্কৃত করে।
সে সময় ‘বীরোচিত’ কর্মকান্ডের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিপি-৮৬১২১৪৭৫৫১) মো. গোলাম সাকলায়েন পান ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক।’
গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের এডিসির দায়িত্বে থাকার সময় ‘তদন্তের সূত্রে’ অভিনেত্রী পরীমণির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান সাকলায়েন। তার স্ত্রীও সরকারি কর্মকর্তার। পরীমণির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরুর পর প্রথমে সাকলায়েনকে ডিবি থেকে সরিয়ে মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাকে ঝিনাইদহ ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। এবার পরীমণি বিতর্কে সেই সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আবেদন করা হয়েছে।
কী করেছিলেন সাকলায়েন?
পুলিশের নির্যাতনের শিকার ছাত্রনেতা রহিম বলেন, ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারা কয়েকজন ঢাকায় হাইকোর্টে জামিন নিতে গেলে তাদেরকে ধরতে সাদা পোশাকে সাকলায়েনের নেতৃত্বে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি টিম পিছু নেয়।
হাইকোর্টের আইনজীবীদের সহযোগিতায় কোর্ট থেকে পলাতে পারেন। কিন্তু সেদিন দিবাগত রাত ১:৩০ মিনিটের দিকে রাজধানীর আদাবরে বিরোধী দলের এক নেতার বাসায় অভিযান চালান এডিসি সাকলায়েন। সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন রহিম এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ অর্থ সম্পাদক শামীম ইকবাল খান। একই সাথে মাগুরা জেলা যুবদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওয়াশিকুর রহমান কল্লোলকেও ফার্মগেট থেকে আটক করা হয়।
তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে নিয়ে গাড়ি রাখে এবং গাড়ি থেকে নামিয়ে, ডিবি টিম রহিমকে নিয়ে যায় মুজিব হলে। তখন তাদের হাতে হাতকড়া এবং চোখ বাঁধা ছিল।
রহিম বলছেন, রাত ৩টার পরে তাকে আবার এডিসি সাকলায়েনের রুমে নিয়ে যায়।
রহিম বলেন, 'আমাকে জিজ্ঞেস করে, “অস্ত্র কোথায়”? আমি প্রশ্ন করি, “ভাই কিসের অস্ত্র?”। আমাকে জিজ্ঞেস করে, "মাগুরায় নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় জগদল বাজারে যে মারামারি হয়েছে সেখানে অস্ত্র ব্যবহার করেছিস সেটা"।'
তখন কিন্তু আমি বলি, ‘সেখানে আমরা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করি নাই। আমাদের উপর অতর্কিত হামলা করা হয়েছে। আমাদের লোকজন আহত হয়েছে। দুইজন ঢাকা মেডিকেলে পঙ্গু হয়েছে। দুইটা মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দিয়েছে এবং কারা অস্ত্র ব্যবহার করেছে উপস্থিত সাংবাদিক, ডিবি, ডিএসবি, এনএসআই তাদের ভিডিও ফুটেজ আছে সবাই দেখেছে। আমরা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করি নাই।'
'তখন এডিসি সাকলাইন আমাকে বলে, "উপর থেকে নির্দেশ আছে তোকে গুম করে দেওয়ার। তোকে মেরে ফেলার। দুই দিন আগে দেখিস নাই বুড়িগঙ্গায় লাশ পাওয়া গেছে যশোরের এক চেয়ারম্যানের, তোকেও বুড়িগঙ্গায় ফেলবো। অস্ত্রের কথা স্বীকার কর।" আমি বলি আমরা তো কোনো অস্ত্র ব্যবহার করি নাই।'—যোগ করেন রহিম।
রহিমের কাছে সে রাতের নিষ্টুর ঘটনা এখনও খুব পরিষ্কার
রহিম বলেন, 'তখন আমার দুই হাতে আবার হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে, টেবিলের উপর হাত চেপে ধরেন এক কর্মকর্তা। আমার ডান হাতে এডিসি হাতুড়ি দিয়ে একটা বাড়ি মারে। আর বলে, "কেবল তো শুরু। এখনো সময় আছে অস্ত্রের কথা স্বীকার করে আর ভালো-মন্দ খেয়েনে"।'
পরেরদিন ১৯ ডিসেম্বর রাত দুইটাই রহিমকে আবার সাকলায়েনের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞেসাবাদ করা হয় কথিত অস্ত্রের বিষয়ে।
এক পর্যায়ে এডিসি সাকলাইন বলেন, 'অস্ত্রের রিপোর্ট থাকুক আর না থাকুক। তোর বাঁচার কোনো লাইন নাই বাঁচতে পারবি না…' –দাবি করেন রহিম।
রহিম বলেন, 'কিছু সময় পরে আমার প্রস্রাবের চাপ দেয়। আমাকে প্রস্রাব করার জন্য আরেকটা রুমে একটা বালতি দেখায় বলে, এইখানে কর। আমি ওই বালতিতে পেশাব ( প্রস্রাব) করতে গেলেই যখনই আমার পেশাব বালতির ভিতরে পড়ে। আমি দূরে ছিটকে পড়ে যাই। শরীরে কোন শক্তি ছিল না শরীরের মধ্যে ঝিনঝিন করছে তখন আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করি। আমাকে দুজনে ধরে আবার লকাবে (হাজতখানায়) নিয়ে যায়।'
রহিম বলেন, ‘তারা বালতিতে বিদ্যুৎ দিয়ে রাখে যাতে পানির সংস্পর্শে হাজতে থাকা বন্দিরা বিদ্যুৎতায়িত হয়, কিন্তু শরীরে নির্যাতনের কোনো চিহ্ন না থাকে।’
২০২৩ সালে কি হলো?
এবার রহিমকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। মাগুরা ভায়না মোড় থেকে তাকে গ্ৰেপ্তার করে।
রহিম বলেন, 'আমাকে গ্ৰেপ্তার করার সময় বলে যে আপনার স্ত্রী আপনার নামে মামলা করেছে। অথচ তখন আমার সন্তান হয় একং তার ২২ দিন বয়স ছিল মাত্র। আমার স্ত্রীকে আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় রেখে এসেছি। তারপর আমাকে রাতে ৩/৪ বার পুলিশের একটি রুমে নিয়ে গিয়ে বলে, “আপোষ করো , ক্ষমতাসীন দলের কাছে”।'
ঐ ঘটনায় ২৮ দিন পরে তার জামিন হলে তাকে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশ ঘিরে করা আরেক মামলায় গ্ৰেপ্তার দেখায়।
সেই পুরোনো মামলায় মাগুরা জেলা আদালতে উপস্থাপন করে ৫ দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ। আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর এবং রিমান্ড শেষে চিকিৎসা প্রতিবেদনসহ আদালতে উপস্থাপনের আদেশ দেন।
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর। ওই দিন সন্ধ্যায় তাকে শ্রীপুর থানায় নিয়ে যায়। খাদ্য-খাবার কোনো কিছুই দেয়নি।
রহিম বলেন, 'এরপর সাড়ে ১২টার দিকে এসআই শরীফুল (ইসলাম) গারদ থেকে বের করে হাতকড়া পরায় এবং গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে একটা রুমে নিয়ে যায়। সেখানে একটা চেয়ারে বসায়। আমাকে সেখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে হাতে আঘাত করে। পায়ের নিচে আঘাত করে। আমাকে ফেলে দেয়। সেখান থেকে আমাকে থানা হাজতে দিয়ে আসে। সেখানেও আমার সাথে একই কাজ করে। ওখানে আমাকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়।'
শক দেওয়া কয়টা থেকে শুরু হলো? রহিমকে জিজ্ঞেস করা হয়। রহিম বলেন, 'রাত দেড়টায় দুই হাত এবং দুই পায়ের আঙ্গুল এ খামতি (ক্লিপ) দিয়া একটা লোহার বার দেয়। আমার চোখ বন্ধ ছিল। এক দেড় মিনিট হবে। এটা দেওয়ার সময় আমি ওরে আল্লারে বলে একটা চিৎকার দেই। এরপর আমি দুই তিন বার পড়ে যাই। এরকম এর আগে হয়নি।'
২০২৪ সালে নির্বাচনের সময় হাজার হাজার নেতাকর্মীদের মতো জেলে ছিলেন রহিম। গত ফেব্রুয়ারি ২৪ তারিখে তিনি জামিনে বের হন।
শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক শরিফুল ইসলাম বলেন, তিনি রহিমকে রিমান্ডে আনেন।
নির্যাতনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি উত্তর দেন, 'আপনি সামনে এসে কথা বলুন।'
ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ তাসনিম আলম জানান, তিনি সে সময় দায়িত্বে ছিলেন না তাই তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন না।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সাতক্ষীরার সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ রায়কেও আটকের পর সাতক্ষীরা পুলিশের কর্মকর্তারা তাকে বিদ্যুতায়িত করে।
এদিকে, ২০১৮ সালের ঘটনার ব্যাপারে মন্তব্য জানতে সাকলায়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে অ্যাডভোকেট ওয়াশিকুর রহমান কল্লোল জানান, তাকে আটক করা হয় ফার্মগেট থেকে। সাকলায়েনের নেতৃত্বে একটি ডিবি টিম তাদেরকে চারদিন চার রাত ডিবি অফিসে গুম করে রাখে।
বিদ্যুতায়িত কেন?
রহিম বলছেন, তাকে তদন্ত কর্মকর্তাদের একজন বলেছেন—আদালতে উপস্থাপনের সময় বা পরে যাতে কোনো আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া যায় সে কারণেই এ ব্যবস্থা। সে সময় পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় সংখ্যালঘুদের ভূমির অধিকার রক্ষায় লেখালেখি করার কারণেই তাকে ' ভুয়া' মামলায় গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হলে সে সময় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে তৎকালীন জেলা পুলিশের প্রধানকে লিখিত আকারে দেবার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। বিষয়টি ঠিক এখন কি অবস্থায় তা নিশ্চিত করা যায়নি।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, অন্যান্য নির্যাতনে যে ধরনের ক্ষত শরীরে দেখা যায় ইলেক্ট্রিক শক দিলে সেটা অনেকটা কম চোখে পড়ে। কিন্তু বর্বরতার দিক থেকে এটা 'ওয়াটার বোর্ডিং' এর চেয়ে কম নয়। যে সমস্ত নির্মম নির্যাতন কৌশল শোনা যায় তার মধ্যে এটি নিকৃষ্টতম। এ ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ তারা মাঝে মাঝে পেয়েছেন।
বাংলাদেশে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় সরকারের কাছে এই আইন সংশোধন করার দাবি জানানো হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদে এ বিল উপস্থাপন করেন। পরে তা আইনে রূপান্তরিত হয়। অনেকের কাছেই বাংলাদেশে পুলিশ কর্তৃক বিরোধী রাজনীতিবিদদের নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালের নিষেধাজ্ঞার পর তারা নির্যাতনের ব্যাপারে সতর্ক হয়েছে।
পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, তিনি মনে করেন পুলিশের কাজে আরো সচেতন হওয়া উচিত। তিনি তার এ কথা বারবার মনে করিয়ে দেন নির্যাতনের শিকার তার নিজের আত্মীয় হতে পারেন।
তিনি মনে করেন, পুলিশের উচিত হবে দীর্ঘদিনের কথিত তদন্ত কৌশল হিসেবে 'নির্যাতন' অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরিবর্তে তদন্তের ভিত্তিতে কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। এতে যেমন অপরাধ কমবে সেই সাথে পুলিশের উপরে মানুষের আস্থা বাড়তে থাকবে।
তিনি এও মনে করেন, পুলিশের নির্যাতনের যে কলাকৌশল রয়েছে তার পরিবর্তনের জন্য পুলিশের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা চাপ কমানো প্রয়োজন রয়েছে।
আরেকজন তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, অনেকে নিজের লাভের আশায় নির্যাতনকে ব্যবহার করেন। কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন একজন কর্মকর্তাকে তার কাজের হিসাব তাকেই দিতে হয়।ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মরত এই কর্মকর্তা আরো বলেন, তিনি এর চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কি বলছে?
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এ বছর ২৬ জুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নির্যাতনের শিকারদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ী পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির অবসান, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
১৯৯৮ সালে নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদ (সিএটি) অনুমোদন এবং নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায়, গত এক দশকেরও বেশি সময়ে নির্যাতন আইনের অধীনে শুধুমাত্র একটি ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার নজির স্থাপিত হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে, মাদক রাখার এক কথিত মামলায়, গত ২ জুন (২০২৪) তারিখে অভয়নগর উপজেলায় গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে ৪০-বছর -বয়েসী আফরোজা বেগম মারা যান। তার বড় ছেলে আরিফ হোসেন মুন্না অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, তিনি দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে অভয়নগর থানায় নিয়ে যাওয়ার আগে তার মায়ের কাছে মাদকদ্রব্য রাখতে এবং তাকে মারধর করতে দেখেছেন। পরদিন সকালে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মায়ের মৃত্যু হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গবেষক তাকবীর হুদা বলেছেন, ‘নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুরতা ঘৃণ্য কাজ এবং কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের হাতে ব্যাপক এবং অব্যাহতভাবে নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত এবং সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন সন্দেহজনক কর্মকর্তাদের, তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত, চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হবে, যাতে তারা আবারও কোনো ক্ষতি করতে না পারে।”
“এটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি সুরক্ষা বিষয়ে অতি নিন্দনীয় অভিযোগ যে, গত দশ বছরে হেফাজতে মৃত্যুর অনেক অভিযোগ থাকার পরও এই আইনে শুধুমাত্র একটি ঘটনায় অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। যাদেরকে হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, আতঙ্কজনকভাবে তাদের দীর্ঘ ও ক্রমবর্ধমান তালিকার মধ্যে আফরোজা বেগমের মৃত্যু একটি।”
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৩ সালের নির্যাতন-বিরোধী আইনে এ পর্যন্ত ২৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে হেফাজতে মৃত্যুর প্রকাশিত খবরের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। জানুয়ারি ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ১৩৮টি মৃত্যুর ঘটনা তালিকাভুক্ত করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যক্তিদের শারীরিক নির্যাতনে তাদের মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটি একই সময়ে কারা হেফাজতে ৯২৩ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা তালিকাভুক্ত করেছে, যে সকল ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
চাঁদাবাজি, হয়রানি ও নির্যাতন
আফরোজা বেগমের ছেলে আরিফ হোসেন মুন্না জানান, তাদের বাড়িতে অভিযানের আগে পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবারকে হয়রানি করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে তিনি বলেন, ‘যে দুইজন পুলিশ অফিসার চাঁদার জন্য আমাদের হয়রানি করছিল, তারা, পরিচিত এক মাদক কারবারীকে সাথে নিয়ে মাঝরাতে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমার বাবাকে খুঁজে না পেয়ে তারা আমার মাকে শারীরিকভাবে তল্লাশি করে, তার চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে অবিরাম থাপ্পড় মারতে থাকে’।
‘তারপর তারা আমার মায়ের কাছ থেকে ১,৮৮,০০০ টাকা আদায় করে। মাদক রাখার জন্য গ্রেপ্তার করার আগে মাদক কারবারীর পকেট থেকে ৩০টি ইয়াবা বড়ি তারা আমার মায়ের পোশাকে গুঁজে দেয়। তারা আমার চোখের সামনেই মাদক গুঁজে দিয়েছে, যাতে তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নির্যাতন কিংবা ও চুরির মামলা করা না যায়।’—যোগ করেন তিনি।
মুন্না আরও জানান, সকালে থানায় তিনি তার মাকে দেখতে গেলে পুলিশ তাকে খাবার বা ওষুধ দিতে দেয়নি, সকালেই তিনি মারা যান। তাদের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার কারণে তিনি মারা গেছেন, দাবি মুন্নার।
মুন্না বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলে তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ১০ জুন তারিখে আমার ছোট ভাই স্কুলে যাচ্ছিল, তখন ওই মাদক কারবারী হুমকি দিয়ে বলে, “তোর পরিবার মামলা করার সাহস দেখালে আমরা তোর মাকে যেমন মেরেছি, তোকেও তেমনি মেরে ফেলব”।’
২০১৩ সালের নির্যাতন সংক্রান্ত আইনে একটিমাত্র ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত
২০১৩ সালের বাংলাদেশের নির্যাতন বিষয়ক আইনের অধীনে একটিমাত্র নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই মামলায় জড়িত ইশতিয়াক হোসেন জনি এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্লবী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে নির্যাতন চালায়। উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ কর্মকর্তারা লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে, লাথি মেরে ভাইদের কাছে টাকা দাবি করে।
যদিও ঘটনাক্রমে রকি তার আঘাত সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে, তার বড় ভাই জনি গ্রেপ্তারের পরের দিন আঘাতের ফলে মারা যায়। বিভিন্ন ধরনের হুমকি, ভীতিপ্রদর্শন, আইনের আওতার বাইরে অনানুষ্ঠানিক মীমাংসার প্রস্তাব, নির্যাতনের মামলা প্রত্যাহরের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে ২০১৩ সালের নির্যাতন বিষয়ক আইনের অধীনে জনির জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য রকি এবং তার পরিবার একটি কঠিন আইনি লড়াই করেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, ঢাকার একটি বিচারিক আদালত, জনির মৃত্যুর জন্য জাহিদুর রহমান এবং দুই সহকারী উপ-পরিদর্শককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এবং তাদের প্রত্যেককে জনির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লক্ষ টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়।
দোষী সাব্যস্ত দুই কর্মকর্তা ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিলেও সুপ্রিম কোর্টে আপিল চলমান থাকায় এবং কোর্ট ক্ষতিপূরণ প্রদান স্থগিত করায় রকি এবং তার পরিবার একটি পয়সা এখনও পায়নি।
এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত পুলিশ পরিদর্শক জাহিদুর রহমান ২০১৪ সালের জুলাই মাসে মাহবুবুর রহমান সুজন নামে আরেক ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। সুজনের পরিবারের কাছ থেকে অ্যামনেস্টির পাওয়া মামলার অভিযোগে বলা হয়, জাহিদুর রহমানসহ অন্যরা জোরপূর্বক সুজনের বাসায় ঢুকে নগদ টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে এবং তাকে নির্যাতন করে। এসময় তারা তার স্ত্রী ও ৫-বছর-বয়সী ছেলেকেও আহত করে। সুজনকে একটি সাজানো অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে মিরপুর মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তার স্ত্রী ও ছেলের উপুর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও সুজনের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। সুজনের স্ত্রী-পুত্র অন্য একটি কক্ষে বন্দী ছিল, যেখান থেকে তারা সুজনের আর্ত-চিৎকার শুনতে পায়।
পুলিশের কাছে সুজনের মায়ের করা সাধারণ ডায়েরি অনুযায়ী, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে তাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ পরে তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা দায়ের করে এবং তাকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পাওয়ার আগে তিনি ছয় মাস জেল খাটেন। সুজনের মৃত্যুর ঘটনায় ২০১৩ সালের নির্যাতন সংক্রান্ত আইনে দায়ের করা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
তাকবীর হুদা বলেন, ‘এটা বিবেকবর্জিত এই জন্য যে, এই সকল নৃশংস অপরাধের জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত অত্যন্ত বেদনাদায়ক ধীরগতির কারণে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের জন্য অবশ্যই বাংলাদেশের একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গড়ে তোলা দরকার। বাংলাদেশের উচিত, নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের ঐচ্ছিক প্রটোকলকে অনুমোদন করা, যাতে বিচার না হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ভুক্তভোগীরা জাতিসংঘের নিপীড়ন-বিরোধী কমিটিতে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করতে পারে।’
পুলিশের ভাষ্য
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র অ্যাসিস্টেন্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল এনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ কোনো অবস্থাতেই হেফাজতে নির্যাতনকে বৈধতা বা সমর্থন দেয় না।
তিনি বলেন, সদরদপ্তর থেকে নির্যাতন আইনে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে পুলিশ সদস্যদের বিরত থাকারই নির্দেশনা দেন।