বিজেপি জোটঃ৩১৯ ,কংগ্রেস জোটঃ৭২ এবং অন্যান্য দলঃ১৫২
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এখন পর্যন্ত এই অভাবনীয় সাফল্যে অভিভূত নরেন্দ্র মোদীর প্রধান মন্ত্রী পদে অভিষেক এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র । তাই প্রবল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী এখন থেকেই ঠিক করে ফেলেছেন তাঁর প্রথম একশো দিনের কাজের অগ্রাধিকার।
মোদীর মতে, অর্থনীতির মরা গাঙে বান আনতে হবে সবার আগে। সে জন্য আর্থিক সংস্কারে জোর দেবেন তিনি। গত দশ বছরে যে সংস্কার অভিমুখ হারিয়েছে বলে মোদীর অভিযোগ।
ক্ষমতায় এলে মোদীর দ্বিতীয় কাজ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ‘হৃতমর্যাদা’ ফিরিয়ে দেওয়া। তাঁর কথায়, “আমি শক্তিশালী ভারত গড়ার কথা বলছি। কিন্তু তার অর্থ দুর্বল রাজ্য আর শক্তিশালী কেন্দ্র নয়। রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করে দেশকে শক্তিশালী করা যায় না। আমি নিজে মুখ্যমন্ত্রী থেকে বুঝেছি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে সমস্যাগুলি কোথায়। এ বার দিল্লির পরিপ্রেক্ষিতে সেই ফাটলগুলো মেরামত করতে হবে।”
মোদী জানেন, এই দুই অগ্রাধিকারকে বাস্তবায়িত করতে গেলে পাশাপাশি আরও একটি কাজ সমান গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে তাঁকে। সেটা হল, তাঁর জমানায় দেশের বিরাট সংখ্যালঘু সমাজের বিচ্ছিন্ন মনোভাব দূর করা। সে জন্য গোড়াতেই কিছু সুনির্দিষ্ট বার্তা দিতে হবে তাঁকে। পৌঁছতে হবে মুসলিম সমাজের কাছে।
নমো নমো! জোধপুরে প্রার্থনা মোদী-সমর্থকদের। ছবি: পিটিআই।
এটা ঠিক যে, ভোট প্রচারে নেমে মুসলিম ধর্মগুরুদের হাত থেকে টুপি পরতে না-চাওয়া মোদী ক্ষমতায় এলেই ভোল পাল্টে সেই টুপি পরে ফেলবেন, এমন নয়। কিন্তু সংখ্যালঘু প্রশ্নে তিনি যে অটলবিহারী বাজপেয়ীর দেখানো পথেই হাঁটবেন, সেই ইঙ্গিত মিলছে। বিজেপি সূত্রে বলা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু প্রার্থী দেওয়া না হতে পারে, কিন্তু মোদী সরকার গড়লে মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘুরা যথাযথ গুরুত্বই পাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো জোরদার করার জন্য মোদীর বেশ কিছু অভিনব ভাবনাও রয়েছে। যেমন রাজ্যগুলির মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো। তবে সেটি নিয়মিত ঘটনা হবে না। বিশেষ জরুরি ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে আলোচনার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে তাঁর মতামত শোনার জন্য। আগে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদে মুখ্যমন্ত্রীদের ডেকে আলোচনা করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই পরিষদটি কার্যত অচল হয়ে গিয়েছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চান।
তবে তাঁর তিনটি অগ্রাধিকার মোদী কতটা সুচারু ভাবে পূরণ করতে পারবেন, তা নির্ভর করবে বিজেপি কত আসন পাচ্ছে তার উপরে। মোদী নিজেও জানেন, প্রশাসনিক সাফল্যের জন্য প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা। জোট-যুগে শরিকদের চাপে বারবার সেই স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। পদে পদে বাধা পেয়েছে আর্থিক সংস্কার। আর মনমোহন সিংহের জমানায় তো শুধু শরিক নয়, সোনিয়া গাঁন্ধীর জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মোদী জমানা এলে সংস্কারের পথে ঠিক সে ভাবেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সঙ্ঘ পরিবার।
বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সঙ্ঘপ্রধান সুদর্শনের সঙ্গে তাঁর বিবাদ সুবিদিত। তখন লালকৃষ্ণ আডবাণী ছিলেন দু’পক্ষের মাঝখানে সেতু। এক বার সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে বাজপেয়ী-আডবাণীর সঙ্গে সঙ্ঘ নেতাদের বৈঠকে বিরাট বচসা হয়। আডবাণীর মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সাধারণ ভাবে পথ প্রদর্শন করলেও দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যকলাপে আরএসএস নাক গলাবে না। বিমা, টেলিকম এবং ব্যাঙ্কিং বেসরকারিকরণ, সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণ নিয়ে সঙ্ঘ, বিশেষত স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের গুরুমূর্তি আর মুরলীধর রাওয়ের সেই বিদ্রোহ নরেন্দ্র মোদীর স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল।
আর এই কারণেই মোদী এ বার প্রথম থেকেই আরএসএসের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চলছেন। কিন্তু সঙ্ঘ নেতাদের এটাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, মন্ত্রিসভা গঠন থেকে শুরু করে বিদেশি লগ্নি সব ব্যাপারে আরএসএসের মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট তিনি মানবেন না। তবে সঙ্ঘের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে চলবেন। আর এই সমন্বয় সাধনের কাজটি করার জন্যই রাজনাথ সিংহকে মন্ত্রিসভায় রাখার প্রস্তাব দিয়েছে আরএসএস। তাঁকে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির সদস্য করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, আডবাণী-সুষমা স্বরাজদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা সঙ্ঘ এখন তাঁর সম্পর্কে সতর্ক মনোভাব নিচ্ছে কেন? আসলে রাজনাথ বা নিতিন গডকড়ী সঙ্ঘের যতটা অনুগত, মোদী যে ঠিক ততটা জো-হুজুর হবেন না, সেটা নাগপুর খুব ভাল করেই জানে। আর সেই কারণেই রাজনাথকে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা আরএসএসের জন্য জরুরি।