দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় কংগ্রেস সে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে।
সেক্যুলার ভারতে বিজেপির সরকার গঠন এই প্রথম নয়। এর আগেও অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠন করে মেয়াদ পূর্ণ করে। কিন্তু কোনো সময়ই এত খারাপ ফল করেনি কংগ্রেস। তাত্ক্ষণিকভাবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও বিশ্ব রাজনীতি বিশ্লেষকদের আরও অনেকদিন এই ইস্যুটি নিয়ে মত দিতে দেখা যাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে যতটা না রাজনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক নীতিমালা। এবারের নির্বাচনে সবকিছুকে ছাপিয়ে সামনে চলে এসেছে গুজরাটের অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গুজরাটের অর্থনৈতিক উন্নতি সর্বভারতে এবারের নির্বাচনে ছিল আলোচিত বিষয়। ভারি শিল্পে গুজরাটের উন্নতি ভারতের ব্যবসায়ীদের বিজেপির প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েছে। আর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নতুন এমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মসূচি জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি যা দেখে ব্যবসায়ীরা কংগ্রেসের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে।
শুধু অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে যে বিজেপি এগিয়ে গেছে তা নয়। এর সঙ্গে কংগ্রেসের ব্যর্থতাও অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে বিজেপিকে। এ সময় যে লোকসভা নির্বাচন হবে, তা অনেক আগে থেকে জানা। কিন্তু সময়টিকে ঠিক মতো ধরতে পারেনি শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটি।
অনেক দেরি করে তারা নির্বাচনের মাঠে নামে। শুধু তাই নয়, জোট গঠনেও কোনো নতুনত্ব বা পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি কংগ্রেস। নরসীমা রাওয়ের পর বেশ কয়েকজন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়ায় ২০০৪ সালের নির্বাচনে। সেবার জোট গঠনে বেশ পারদর্শিতা দেখান কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধী। তিনি নিজে ছুটে যান সিপিএম নেতা হরকিষাণ সিং সুরজিত্-এর বাসভবনে। সেক্যুলার ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমন্বয় ঘটাতে সেবার মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সুরজিত্। তাকে সে সময় বলা হয় কিংমেকার।
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে সেবার সরকার গঠনের পর ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় অবিশ্বাস্য গতিতে। কিন্তু ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এবারের জোট গঠনে কংগ্রেস কোনো পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি।
তৃণমূল, এআইএডিএমকে, সিপিআই, সিপিএম, বিএসপি, এসপিসহ ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলোকে আস্থায় আনতে সক্ষম হয়নি কংগ্রেস। শুধু তাই নয়, নরসীমা রাওয়ের সময় রাজ্যভিত্তিক সমঝোতা যা হয়েছিল, সে রকম কোনো বোঝাপড়া করতে বা প্রকাশ্যে আনতে পারেনি কংগ্রেস।
কিন্তু এ সময়কালে এই দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। আর রাজ্যভিত্তিক দলগুলোর স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বও কংগ্রেসকে জোট গঠনে বেশিদূর অগ্রসর হতে দেয়নি। বিশেষত দুই নৌকায় পা দিয়ে চলেন মমতা ব্যানার্জি এবং জয়ললিতা।
আর বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে সব সময়ই জাত-পাতবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি জয়লাভ করেছে। কিন্তু এবারই প্রথম অবিস্মরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে বিজেপি। মুলায়ম সিং যাদব ও মায়াবতীর যুগপত্ ব্যর্থতা বিজেপির সাফল্য অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
সর্বোপরি কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে কোনো নায়ক তৈরি করতে পারেনি, যার ওপর ভর করে দলটি পরিচালিত হতে পারে, বিজেপি যেমনটি করেছে মোদিকে কেন্দ্র করে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেউলিয়াপনার জন্য বিশ্লেষকরা এবারও পারিবারিক নেতৃত্ব তাকে দায়ী করবেন। এক পরিবারের তিনজন, মা সোনিয়া, মেয়ে প্রিয়াঙ্কা, ছেলে রাহুল সমানতালে দল পরিচালনা করেছেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় প্রণব মুখার্জির মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের প্রকাশ্য পরামর্শ থেকে এবার কংগ্রেস বঞ্চিত হয়েছে। সর্বোপরি অনেক দেরিতে নির্বাচনী কাজ শুরু করায় কংগ্রেস শুরুতেই দৌড় থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। কংগ্রেসের রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক বেশি এবার আলোচিত হয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। সেই সঙ্গে ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা।
একই ক্যানভাসে সাধারণ মানুষ দেখেছে গুজরাটের উন্নতি এবং সেখানকার কর্মসংস্থান। তারপরও এই ভরাডুবির মাত্রা আরও কমানো যেত ভালোভাবে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠন করতে পারলে, যার ওপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন কংগ্রেস রাজনীতি করছে।