DMCA.com Protection Status
title="৭

নারায়নগন্জের গডফাদার নূর হোসেনের অনুপস্থিতিতে সাবেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিন আবার লাইম লাইটে

giashদৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ  নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহরণ করে সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের শত শত কোটি টাকার অবৈধ সাম্রাজ্য এখন দখল নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন।

 

‘নদীখোকো’ খ্যাত সাবেক এই এমপির ক্যাডাররা এরই মধ্যে শুরু করেছে দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি। আবার কোথাও কোথাও চলছে অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠনের প্রস্তুতি ও পাঁয়তারা। সিদ্ধিরগঞ্জ ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য।

 

অভিযোগ উঠেছে, ২০০১ সালে এমপি হওয়ার পর গিয়াস উদ্দিন যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করেছিল ২০০৮ সালের পর সেই পথেই হেঁটেছিল নূর হোসেন। যা এমপির অপরাধকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। যদিও ’৯০-এর দশকে এক সময়ের ট্রাক ড্রাইভার নূর হোসেন অপকর্মে আরও সিদ্ধহস্ত ছিল। ফলে প্রতিরোধের মুখে বিএনপির শাসনামলে তাকে দেশ ছেড়ে ভারতে থাকতে হয়েছে।

 

জানতে চাইলে সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমার কোনো বাহিনী ছিল না, এখনও নেই। আমার ঘনিষ্ঠ কেউ দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসে জড়িতও নয়। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এবং তা প্রমাণ হলে প্রশাসন নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে। আর আমার মালিকানাধীন মার্কেট দখলে নেয়ার কী আছে! নূর হোসেনের অপকর্ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল নূর হোসেন। তার বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিল ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ।

 

সে আমার কাছ থেকেও এক কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিল। আমি না দেয়ায় নির্মাণাধীন মার্কেটের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ রেখেছিল।

 

দখল ও চাঁদাবাজিতে গিয়াসের ঘনিষ্ঠরা: ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুলসহ সাতজন অপহরণ ও খুনের পর এ সংক্রান্ত মামলার প্রধান আসামি আত্মগোপন করেন। দীর্ঘদিন দখলে থাকা নূরের অবৈধ সম্পদ ও বিভিন্ন স্থাপনা বেদখল হওয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় নূর হোসেনের দখলে থাকা হাজী বদরুদ্দিন সুপার মার্কেট ও পাশের অন্তত ১৫ থেকে ২০টি দোকান দখলে নেয় এমপি গিয়াস উদ্দিনের লোকজন।

 

এছাড়া বিএনপির আমলে গিয়াস এমপির ডানহাত-বাঁহাত স্বীকৃত ডেমরা সারুলিয়ার জামান-সেলিম এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এদের সঙ্গে রয়েছেন গিয়াস এমপির শ্যালক জুয়েলও। তারা বিভিন্ন অবৈধ আয়ের স্পটে বাহিনী নিযুক্ত করতে দফায় দফায় গোপন বৈঠক করছেন। এরই মধ্যে বেশ কজনকে মাঠে নামিয়েছেন দখল ও চাঁদা আদায়ে।

 

এদের মধ্যে চিটাগাং টু যাত্রাবাড়ী রোডে চলাচলকারী গাড়ি ও শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে থেকে চাঁদা তুলতে শিমরাইল টেকপাড়ার আনু, বিল্লাল, সোহেল, নূর মোহাম্মদকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা সিটি করপোরেশনের নামে নির্ধারিত ৫০ টাকার পরিবর্তে প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে।

 

মাইক্রোস্ট্যান্ড ও বেবিট্যাক্সির প্রতিটি থেকে ৫০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করছে ইকবাল, শিবলী, সানারপাড়ের তোফায়েল, লেটুর সামাদ। শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকার দোকান ও ফুটপাথ থেকে হাসান পারভেজের নেতৃত্বে এবং রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে হতে সিদ্ধিরগঞ্জ ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পর্যন্ত (মুরগি পট্টি, ফুটপাথসহ) ফুটপাথের দোকান থেকে গড়ে ১০০-১৫০ টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে। এ ছাড়া নূর হোসেনের দখলে থাকা বালু ও পাথর বাণিজ্যও দখলের জন্য বেশ কজনকে দায়িত্ব দিয়েছে জামান-সেলিম।

 

এসব দখলে প্রশাসনের অবস্থান বুঝে ধীরগতিতে এগোনোরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নূর হোসেনের আত্মগোপনে সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন বিএনপির সাবেক এই এমপি। কারণ চিরশত্রু নূর হোসেন অসংখ্য ঝামেলায় জর্জরিত করে রাখতেন গিয়াস এমপিকে।

 

সরকারি ও অর্পিত সম্পত্তির মালিক গিয়াস: এমপি হওয়ার পর এলাকায় অনেক জমিরই মালিক বনে যান এমপি গিয়াস। তিনি দখল করেন সরকারি ও অর্পিত সম্পত্তিও। এর মধ্যে রয়েছে গিয়াস উদ্দিন ইসলামিক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জমি। সাবেক জিআর টেক্সটাইলের এ জমির মধ্যে আঁটি মৌজার ১০৮ দাগে ৩ বিঘা, ১১৩ দাগে ৩৪ শতাংশ এবং ১১৬ দাগে ৩৫ শতাংশ জমির অধিকাংশই সরকারি খাসজমির অন্তর্ভুক্ত; যা বিভিন্নভাবে দখলে (ভুয়া দলিল করে) রেখেছেন সাবেক এই এমপি।

 

গিয়াস উদ্দিনের মালিকানাধীন সিদ্ধিরগঞ্জ টাওয়ারের জমি নিয়েও অভিযোগ মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিমরাইল মৌজার ১৪ শতাংশ এ জমি অর্পিত সম্পত্তি। এই জমির প্রকৃত মালিক মোহাম্মদ হক দেশ স্বাধীনের সময় পাকিস্তান চলে গেলে সিদ্ধিরগঞ্জের একজন তা দখল করে। আর তার থেকে এ জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন গিয়াস। বর্তমানে এ টাওয়ারের কাজ চলছে।

 

নূর হোসেনের দখলে থাকা হাজী বদরুদ্দিন সুপার মার্কেটের জমি নিয়ে বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে মামলা চলমান। এই জমির ক্রয়সূত্রে মালিকানার দাবিদার এমপি গিয়াস এবং নূর হোসেন ও নারায়ণগঞ্জের মাসুদ।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, চিটাগাং রোডের আঁটি মৌজার ৩০ দাগের ১০ শতাংশ এ জমির প্রকৃত মালিক চট্টগ্রামের বাসিন্দা মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন। প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে ১৯৯৬ সালের পরে ৩০ লাখ টাকায় জোরপূর্বক এ জমি কিনে নেয় নূর হোসেন ও মাসুদ। যদিও এ জমির ওয়ারিশের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে মালিকানা দাবি করে আসছেন গিয়াস উদ্দিন। বিএনপি আমলে মার্কেটটি তার দখলেও ছিল। ২০০৮ সালের পর থেকে নূর হোসেন তা আবার দখলে নেয়। নূর হোসেনের পলায়নের পর চলতি মাসের শুরু দিকেই এই মার্কেটটি দখলে নেয় গিয়াস উদ্দিনের ঘনিষ্ঠজন।

 

গিয়াস উদ্দিনের আমলে চার হত্যাকাণ্ড ও নানা অপকর্ম: ২০০১ সালে গিয়াস উদ্দিন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চারটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এর মধ্যে দুটি মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি সাবেক এই এমপি। যদিও এরই মধ্যে মামলার বিচার শেষ হয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলোর অভিযোগ— ২০০১ সালে গিয়াস উদ্দিন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ওই এলাকার বিভিন্ন চুন কারখানা থেকে তার বাহিনী চাঁদা আদায় করতে থাকেন।

 

এর প্রতিবাদে ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সিদ্ধিরগঞ্জের ১৪টি চুন প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। এর তিন মাসের মাথায় চুন সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুন্দর আলী নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি ক্লিনিকের সামনে খুন হয়। একই বছর খুন হয় সিদ্ধিরগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী মোজাফ্ফর। 




এ ছাড়া ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি খুন হয় নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের ছোট ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাব্বির আলম খন্দকার। এ ঘটনায় তৈমূর বাদী হয়ে গিয়াস উদ্দিনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর পরের বছর ১৬ ডিসেম্বর খুন হয় সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়া এলাকার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা কফিল উদ্দিন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে তাকে বিরোধীরা খুন করেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

 

অভিযোগ আছে, গিয়াস উদ্দিন এমপি থাকাকালে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ১ দশমিক ৯৭ একর জমি লিজ নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে বালু ব্যবসা করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছেন। এ ছাড়াও সড়ক ও জনপথে, এলজিইডি ও সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্রে নিজস্ব পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এ সময় এমপির সাহচর্য পেয়ে ঠিকাদার হাসমত আলী হাসু, ছোট হযরত, বড় হযরত, সালাউদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর, ফজলুল হক ফজলু কেরানী, আবদুল হাই রাজু, এমএ হালিম জুয়েসহ অনেকেই অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। এদের থেকে অবৈধ সুবিধা পেয়েছেন এমপিও।

 

গিয়াসের রাজনৈতিক আদর্শও প্রশ্নবিদ্ধ: গিয়াস উদ্দিন জনপ্রিয় নেতা হলেও সময়ের প্রেক্ষাপটে ও ক্ষমতার লোভে বারবার দলবদল তার রাজনৈতিক আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের ওমরপুর এলাকার আবুল হাসেম সাউদের একমাত্র ছেলে গিয়াস উদ্দিন বিএনপির সাবেক এমপি। বর্তমানে চার সন্তানের (ফয়সাল, সাদরিল, রিফাত ও কাউসার) জনক তিনি। গিয়াস উদ্দিন ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।

 

১৯৭৩ সালে ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। জনহিতকর কাজের সুবাদে এলাকায় জনপ্রিয়তা পান এ নেতা। ১৯৭৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ সময় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গিয়াস উদ্দিনকে বিএনপিতে যোগদানের প্রস্তাব দেন। এমনকি তাকে সরকারি খরচে নেপাল ভ্রমণেও পাঠান। তবুও গিয়াস উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে ছিলেন।

 

এরপর ১৯৮৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর ১৯৮৬ সালে উপজেলা নির্বাচন দিলে গিয়াস উদ্দিন জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে নারায়ণগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচন করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ সময় তার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদটি শহিদুল ইসলামের (নিহত নজরুলের শ্বশুর) কাছে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন বলে জনশ্রুতি আছে।

 

১৯৯৫ সালে জাতীয় পার্টি থেকে গিয়াস উদ্দিন পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন গিয়াস উদ্দিন। তখন শামীম ওসমান এমপি নির্বাচিত হলে গিয়াস উদ্দিন তত্কালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফের শেল্টারে থাকেন। এ সময় গিয়াস উদ্দিন জাতীয় কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

 

২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে গিয়াস উদ্দিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন। এসময় শামীম ওসমান আবারও মনোনয়ন পেলে গিয়াস উদ্দিন ওই বছরের ১৪ আগস্ট বিএনপিতে যোগদান করে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে গিয়াস উদ্দিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সেই আদর্শেই আছেন।

 

 

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গিয়াস উদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতিবাজদের ৩৫ নং তালিকাভুক্ত ছিল। সে সময় তার বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। গিয়াস উদ্দিন আদালতে আত্মসমর্পণ এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। পরবর্তী সময় সব মামলা থেকে খালাস পান তিনি। বর্তমানে সাবেক এই এমপি রাজনীতির পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকায় স্থাপিত গিয়াস উদ্দিন ইসলামিক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!