কংগ্রেসের ওপর ভর করেই এতোদিন ক্ষমতা ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। সেই সঙ্গে হাসিনা সরকারের জোর কমে যাবে বিএনপির এমন ধারণাকে পাগলের প্রলাপ বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, বিএনপিও জানে এ বিজেপির সঙ্গে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই গঙ্গার পানি চুক্তি করেছিল। কিন্তু বিএনপি গুজব ছড়ায় কংগ্রেস ভারতে ক্ষমতায় নেই, আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। অতীতেও হেফাজতের সমাবেশের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছিল তারা। এতে সাময়িকভাবে সরকার কিছুটা বিব্রত হলেও ঠিকই তা কাটিয়ে উঠেছে। এবারও বিএনপি ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় ও কংগ্রেসের হার এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়ে গুজব রটাচ্ছে। এতে মোটেই সঙ্কিত নয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সূত্র মতে, ভারতের ক্ষমতার পালাবদলে বিএনপির উল্লাসে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ ভারতের অতীত ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় তাদের ক্ষমতার পালাবদ হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক রয়েছে, তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবসময় ইতিবাচক ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। দেশের স্বার্থ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিস্তাচুক্তিসহ যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাৎ না দেয়ায় একটা বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয় কংগ্রেসের সঙ্গে। তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিএনপি। যার খেসারত দিতে হয় গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। শুধু কংগ্রেসের সমর্থনের কারণেই শেখ হাসিনা এককভাবে নির্বাচন করে উৎরে যান। কিন্তু এখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকা কষ্টকর হবে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করবে।
গত শনিবার রাজধানীর এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ে বাংলাদেশে যারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে তারা ‘আহাম্মক’। যারা বলেন মোদি এসেছে, কংগ্রেস নেই, আওয়ামী লীগ থাকবে না। তাদের বলতে চাই, যাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে তারা এটা বলতে পারেন না। যারা এগুলো বলেন, ফরেন পলিসি সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই।’
এর একদিন পরে গত রোববার রাজধানীর একটি আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে। তারা আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমরা আশা করি, আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভারতের নতুন সরকার বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কথা অনুধাবন করে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের মন্ত্রীরা অনেকে বলছেন, ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ও বিএনপি নাকি উল্লসিত হয়েছে। কোথায় দেখছেন তাদের এই উল্লাস? বরং এই নির্বাচনের ফলাফলের পর সরকারি দলের নেতারাই নার্ভাস হয়ে নানা কথাবার্তা বলছেন।’
নরেদ্র মোদির বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি টেলিফোনে কথা বলেছেন মোদির সঙ্গে। বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন মোদিকে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও টেলিফোনে মোদিকে অভিনন্দন জানান।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের অবস্থানের পর তাদের নির্বাচনের গুরুত্ব বেড়ে যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক মিত্র কংগ্রেসের ভরাডুবিতে নতুন করে সমস্যায় পড়বে বর্তমান সরকার। কারণ বিজেপি সরকার গঠন করলে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বিজেপির পুরনো সম্পর্ক এক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ামক হতে পারে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ‘ভারতের নির্বাচন নিয়ে উল্লসিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ভারতে নতুন সরকার গঠিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান বন্ধুত্বের সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হবে। ভারতে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের মতো বৃহৎ একটি রাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয় না এটা বিএনপি নেতারাও জানেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকলেও বিজেপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। ৯৬-এ গঙ্গার পানিচুক্তি হয়েছে এই বিজেপির সঙ্গে, আশাকরি এবার তিস্তাচুক্তিও হবে।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘ভারতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ সুন্দর সম্পর্ক বজায় থাকবে। শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, দক্ষিণ এশিয়ার স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি তারা ভালোভাবে অনুধাবন করবে, সজাগ থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। ১৯৯৬ সালের গঙ্গাচুক্তির কথা নিশ্চিয় আপনাদের মনে আছে। সুতরাং বিজেপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া বিজেপির আমলেই পার্বত্য শান্তিচুক্তিও হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতেও দেশের স্বার্থ রক্ষা করে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা যে কোনো বিষয় সমাধান করে সামনে অগ্রসর হতে পারব ‘