মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে সাংবিধানিক কোন সমস্যা না থাকলেও রয়েছে আইনগত সীমাবদ্ধতা। এই আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনও হয়ে পড়েছে ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া, নাৎসিবাহিনীর বিচারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কোন সংগঠনের বিচার কেবল আইন দিয়ে সম্ভব হয় না। আইন ও বিচারের মাধ্যমে অভিযোগের প্রমাণ করতে পারলেও সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।
ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনের বিচারের সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জার্মানি। জার্মানির মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও মানবতাবিরোধী বিচারের ক্ষেত্রে যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭(৩) ধারা অনুসারে, এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।
এতদসত্ত্বেও রয়ে গেছে আইনগত সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা টের পাওয়া যায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কোন সংগঠনের বিচারের সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী জার্মানির দিকে তাকালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নাৎসি বাহিনীর বিচার করা হয়। এই বিচারের জন্য স্বাক্ষর করা হয়েছিল বার্লিন পোস্টডাম কনফারেন্সে।
পোস্টডাম এগ্রিমেন্ট অনুসারে, নাৎসিবাহিনীর যে কোন সহযোগী সংগঠন চিরতরে সমূলে ধ্বংস করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সে অপরাধকে বৈধতা দানের চেষ্টার সাথে জড়িত যে কোন সহযোগী সংগঠনকে আইনের আওতায় নিষিদ্ধ এবং ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এছাড়া, পোস্টডাম এগ্রিমেন্টে নাৎসিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণে জনগণের সহায়তা নিশ্চিত করার জন্যও কর্মসূচী গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এমনকি, বিচার পরবর্তী সময়ে নাৎসিবাহিনীর মতো আর কোন সংগঠন যেন সৃষ্টি হতে না পারে তার পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। সে লক্ষ্যে, জার্মানিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের পরামর্শও দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতন্ত্র চর্চা ও সামগ্রিকভাবে জার্মানিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়।
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট মতবাদের ভিত্তিতে ঘটান হয়েছিল। একাত্তরের পরও স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মতবাদের বিকাশ ঘটেছে। এর উপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলাম অসংখ্য সহযোগী সংগঠন গড়ে তুলেছে। একক সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলেও এই সহযোগী সংগঠনগুলোও মানবতাবিরোধী অপরাধের বীজ আগামী বাংলাদেশের জন্যও বহন করে চলবে। তাই, সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইনে এই মতবাদকে চিহ্নিত করার বিধান আবশ্যক।
এমনকি, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কিভাবে জামায়াতের সহযোগী সংগঠনগুলোকে চিহ্নিত ও মূলোৎপাটন করা হবে তাও উল্লেখ থাকা উচিত। এছাড়া, আগামী বাংলাদেশ কিভাবে যেকোন মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিহত ও প্রতিরোধ করতে পারবে তার জন্যও প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও বাস্তবায়ন। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই বিষয়গুলো উল্লেখ নাই। এই আইনের অধীনে কোন সংগঠনের বিচারের এই সীমাবদ্ধতাগুলো বারবারই আলোচনায় উঠে আসছে। এখন আইনটির সংস্কারের অপেক্ষা।