দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি প্রথম কোন দেশ সফর করবেন তা নিয়ে চলেছে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। তালিকায় প্রথম সারিতে ছিল বাংলাদেশ, শ্রীংলকা, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। একইভাবে ছিল ভারতের অস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা রাশিয়া ও চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত চীনের নামও। কিন্তু সকল প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে মোদি প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটানকে।
জুনের মাঝামাঝি ভুটান সফরে যাবেন নরেন্দ্র মোদি। মোদির সফরের আগেই দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর সফরের নিরাপত্তা দেখতে হাজির হয়েছেন মোদির মন্ত্রীপরিষদের অনেকেই। তাদের সাথে থাকছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বিশাল বহরও।
নরেন্দ্র মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিজের প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভুটানকে বেছে নিয়েছেন। আর মোদির এই সফরের পিছনে রয়েছে অনেক কারণ। ২০০৩ সালে ভুটান সরকার দেশটিতে থাকা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায় ও দেশটি থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করে। আর ভুটানই একমাত্র দেশ যারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে এমন কঠোর অভিযান চালিয়েছে। এছাড়া ভারতের দিক দিয়ে ভুটান সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিবেশী। ভারতের প্রতি ভুটানের শতভাগ নির্ভরতা ও ভুটানে ভারতের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য মোদি নিজের প্রথম সফর হিসেবে ভুটানকে বেছে নিয়েছেন।
মোদি প্রথম বিদেশ সফরে কোন দেশে যাবেন, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের এমন তালিকায় বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার নামও ছিল। তবে এই বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা সফর করলে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিরোধ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হতেন মোদি। যে কারণে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকাকে সফরের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন তিনি।
ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই ভেবেছিলেন, মোদির প্রথম সফর হবে বাংলাদেশে। নির্বাচনকালীন মোদির বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ অসন্তুষ্ট থাকায় মোদি বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে তারা মনে করেছিলেন। একই সাথে ভারতের সবচেয়ে ভাল বন্ধু(আওয়ামী সরকারের দাবী অনুযায়ী) হওয়ায় বাংলাদেশই ছিল মোদির প্রথম তালিকায়। এই নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে বাংলাদেশকে এড়িয়ে গেছেন তিনি।
বাংলাদেশ সফরে আসলে মোদিকে স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তার পানি চুক্তির মুখোমুখী হতে হতো। স্থল সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাপ থাকলেও এই চুক্তির বিরোধিতা করছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। এছাড়া বিজেপিও ২০১৩ সালে কংগ্রেস সরকারের প্রস্তাবিত স্থল সীমান্ত চুক্তির ঘোরতর বিরোধিতা করেছিল। যে কারণে মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেননি।
একইভাবে মোদির শ্রীলংকা সফরে না যাওয়ার কারণও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। মোদির শ্রীংলকা সফর দেশটির তামিলনাড়ুর সকল রাজনৈতিক দলই বিরোধিতা করবে। মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির কারণে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী শপথ অনুষ্ঠান বয়কট করেছিল। যা মোদিকে মোটেও সন্তুষ্ট করেনি। যে কারণে মোদি বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা সফরকে প্রথম সফরের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী অফিসও অন্য যেকোন সময় দেশ দুটিতে সফরের বিষয়ে জোর দিয়েছে।
এর বাইরে রাশিয়াও মোদির প্রথম সফরের তালিকায় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তানের উপর থেকে রাশিয়া অস্ত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় ও পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি শুরু করায় মোদি রাশিয়াকে তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলেন। ঐতিহাসিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কারণে চীন বা জাপানও হতে পারত মোদির প্রথম সফরের দেশ। চীনের সাথে শত্রুতা থাকলেও গত বছর চীনের প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্য চীনা প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেই পাকিস্তানের বিমান ধরেছিলেন। যে কারণে কিন্তু মোদি চীনের প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথে চীন সফরে যাচ্ছেন না। আর ভুটান এই সকল সমস্যা থেকে একেবারেই মুক্ত। যে কারণে নিরাপদ ভুটানকেই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছেন মোদি। এছাড়া নিরাপদ প্রতিবেশী ও একাত্ম বন্ধুত্বের বিষয়টিতে জোর দিয়েও মোদি ভুটানকে বেছে নিয়েছেন।
ভুটান ভারতের অতিবন্ধুসুলভ প্রতিবেশী হলেও ভারত কখনোই ভুটানকে তেমন আমলে নেয়নি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী, রাজাসহ সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত ভারত সফরে আসলেও ভুটানে কোন ভারতর প্রধানমন্ত্রী সফরে গিয়েছিলেন আরো ছয় বছর আগে। ২০০৮ সালে মনমোহন সিং ভুটান সফরে গিয়েছিলেন।
নিজের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ছাড়াও চীনের সাথে সীমান্ত থাকার কারণে ভুটান ভারতের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। ভুটান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চীন। ভুটানের সাথে ভারতের ৬০৭ কিলোমিটার আর চীনের ৪৭০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। চীনের সাথে ভুটানের পূর্ণ কূটনীতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন ভুটানে পূর্ণ কূটনীতিক মিশন চালু রেখেছে। কারণ ভারতের প্রতিবেশী হওয়ায় ভুটানের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে চীন সরকার।
ভুটানের সাথে চীনের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলেও ভারতের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ভুটান ভারতের আমদানি ও রপ্তানিতে সবচয়ে বড় সহযোগী। দেশটি নিজেদের প্রয়োজনের ৯০ ভাগ ভারত থেকে আমদানি করে আবার মোট রপ্তানির ৯৮ভাগই করে ভারতে। এছাড়া পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যও ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র ভুটান। ভুটানের সাথে ভারতর ভাল সম্পর্কের পরেও কংগ্রেস সরকার ২০১৩ সালে ভুটানকে দেওয়া জ্বালানি তেলের ভর্তুকি প্রত্যাহার সম্পর্কিত বিল পাশ করে। যা ভুটানকে কিছুটা হলেও ব্যথিত করে।
তবে মোদির প্রথম বিদেশ সফরে ভুটানের নাম, ভুটানকে নতুন করে ভারত সম্পর্কে ভাবাবে। একইভাবে রক্ষা হবেভারতের স্বার্থ। কারণ ভারত ভুটানে ১ হাজার ৪শত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে এরইমধ্যে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ভুটানের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যবহার করে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ভারত। এই সব প্রকল্পে ভারত সরকার ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে।
ভুটানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ভারত জ্বালানিখাতে বিশ্বের পরাশক্তিতে পরিণত হবে। এছাড়া ভারতের দূর রাজ্যগুলোর সম্পদ কেন্দ্রে আনয়নে ভুটানের ভেতর দিয়ে রেলপথ নির্মাণের বিষয়টিও মোদির বিবেচনায় আছে। আর এই সকল স্বার্থ ও ভারতের ধনকুবেরদের বিনিয়োগকে নিরাপদ করে তুলতে নিজের প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভুটানকে বেছে নিয়েছেন মোদি।