দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১৯ ধারার বৈধতার প্রশ্নে দায়ের করা রিটের রায় ঘোষণা হলে হঠাৎ করেই সরকার শুন্য হয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
আদালত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করলে বর্তমান সংসদের ১৫৪ টি আসনের সংসদ সদস্যরা বৈধতা হারাবে।
ফলস্বরুপ আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিবার্য হয়ে পড়বে। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের সংসদ-সদস্যই অবৈধ হয়ে পড়ায় অস্বিত্বহীন হয়ে পড়বে সরকার। কিন্তু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কারা, কিভাবে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নেবে? আর এই চ্যালেঞ্জটিকে কিভাবে মোকাবেলা করবে আওয়ামী লীগ?
পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা অনুসারে, নির্বাহী বিভাগ কিংবা অন্য কোন সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আদালতের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করার ফল হতে পারে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির কারণ। এছাড়া, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। যেমনটি ঘটেছে থাইল্যান্ডে।
থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত ইয়াংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো আরেকটি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারেনি। ফলস্বরূপ, আজ থাইল্যান্ডে চলছে সেনাশাসন।
অপরদিকে, পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফের সেনা শাসনকে আইনগত বৈধতা দেওয়া বিচারপতি ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরীই হয়ে উঠেছিলেন সাবেক সেনা শাসকের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। পারভেজ মোশাররফের উদ্দেশ্যে ছিল, সংবিধানকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে নিজের শাসনের মেয়াদকাল আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধি করতে। কিন্তু সে সময় সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারক ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরী ঠিক কি রায় দেবেন তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যান পারভেজ মোশাররফ। সেই সংশয়ের কারণেই তিনি ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরীকে পদচ্যুত করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় তরান্বিত হয় মোশাররফের পতন।
কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা থাইল্যান্ডের পথে না হেঁটে চলতে পারে একেবারেই ভিন্ন পথে। গড়পড়তা কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের বর্তমান দেশ শাসনে অনেকটাই অসন্তুষ্ট আন্তর্জাতিক মহল। বাংলাদেশ গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আছে বলে ঘোষণা দিয়েছে আইএমএফ,যদিও এই অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধমানশীল ব্যক্তি খাতের দ্রুত বিকাশ। তদুপরি আওয়ামী লীগ নিয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, বিতর্কিত দশম সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাদের অনেকের সমস্যা না থাকলেও দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিতর্কিত একটি সরকার দেখতে চায় না আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। একইভাবে, ফলাফল যাই হোক, বর্তমান সরকার ভেঙ্গে নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আরেকটি সরকার দেখতে চায় দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক। তাই, রিটের রায়ের ফলে আরেক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আবারও সরকার গঠন করলে দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়ে যাবে বহুগুণ। সেক্ষেত্রে প্রায় ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে দলটি। একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়বে, দেশীয় উদ্যোক্তারাও অনেক বেশি আস্থা পাবে। ফলে, দেশের অর্থনীতিও ২০২১ সালের মধ্যে মজবুত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি পাবে।
বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিষয়ে আদালতের রায়ের খামতির কারণেই আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং ঠিক কোন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হবে তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোন দিক-নির্দেশনা ছিল না আদালতের রায়ে। ফলে, একেক রাজনৈতিক দল একেক অবস্থান নিতে পেরেছে। এবং দশম সংসদ নির্বাচনের মতো ‘একপেশে’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই ঘাটতি পূরণের জন্য আরও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রায় ঘোষণার এখতিয়ার আদালতের আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোন কিছু ঠেকাতে, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচনের রূপরেখাও দেখিয়ে নূন্যতম সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিতে পারে আদালত। আইনের ব্যাখ্যাকারক হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের এমন রায় দেওয়াতে কোন সমস্যা নাই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরবর্তীতে একটি নির্বাচিত সরকার সুপ্রীম কোর্টের রায়টিকে সংসদ দ্বারা বৈধ করে নিতে পারে।
আওয়ামী লীগ যদি আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে লড়াইয়ে না নেমে রায়কে শ্রদ্ধা করে তবে সৃষ্ট পরিস্থিতি অগণতান্ত্রিক শাসনের আশঙ্কাকেও অনেকাংশেই কমিয়ে আনবে বলে দাবি করছেন পর্যবেক্ষকরা। কেননা বিএনপির মতো দলগুলো কৌশলগত ও অবস্থানগত কারণে যেকোন অগণতান্ত্রিক শাসন নেমে আসার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইবে না। এছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায় মেনে নিয়ে বিএনপিরও নির্বাচনে না আসার কোন কারণ থাকবে না। বিএনপি শুরু থেকেই চাইছে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে। এই পরিস্থিতিতে, নুন্যতম সময়ে কেবল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের জন্যই স্বস্তি বয়ে আনবে।
একারণেই, আরপিও’র ১৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের রায়ে চলমান রাজনৈতিক সংকটের একটি সমাধান খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন বিশ্লেষকরা।