DMCA.com Protection Status
title="৭

সৈয়দ আশরাফের কথার অগ্রপশ্চাৎ

12487_10202665596373631_1255596890_nসৈয়দ আশরাফের কথার অগ্রপশ্চাৎঃ

মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক





বাংলাদেশে সংবাদের কোনো শেষ নেই। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন তথা ১১ খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই সংঘটিত হয় বৃহত্তর নোয়াখালীর ফুলগাজীতে উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হত্যাকাণ্ড। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে যদি প্রতিদিন প্রকাশিত সংবাদের জরিপ করা হয়, তাহলে গড়পড়তা কমবেশি এক ডজন খুনের, এক ডজন অপহরণের, এক ডজন ধর্ষণের খবর পাওয়া যাবে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি যারা করে তারা নিশ্চিতভাবেই আইন ভঙ্গকারী, অসামাজিক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মানুষ; কিন্তু এর সাথে যদি দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় যুক্ত হয়, তখন এসব নেতিবাচক বিশেষণ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়টি যদি শাসক দল বা মতাসীন দলের হয় তাহলে হত্যা, গুম, ধর্ষণকারীদের জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ‘সোনায় সোহাগা’। বাংলাদেশে বর্তমানে ঠিক এরকম একটি অবস্থা বিরাজমান। সম্মানিত পাঠক যাদের বয়স পঞ্চাশের কম, তাদের জন্য ইতিহাস থেকে দু’টি কথা বলছি।


এরকম একটি অরাজক বিশৃঙ্খল আতঙ্কময় পরিবেশ-পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল ১৯৭৩-৭৪-৭৫ সালেও। সে সময়ও শাসকদলীয় রাজনৈতিক পরিচয় বহনকারী ব্যক্তিরা খুন-খারাবি ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সে সময় আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং আওয়ামী লীগ দলীয় ষড়যন্ত্রকারীরা যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল। ওই ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি যৌথ রাজনৈতিক ও সামরিক বিদ্রোহ সসংঘটিত হয়েছিল। ইংরেজি ভাষায় বলা যায়, ‘জয়েন্ট পলিটিকো-মিলিটারি কুদেতা’। সে বিদ্রোহের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন করা হয়েছিল।


উপরের কথাগুলো এবং প্রাসঙ্গিক আরো কথা এখানে আমি বলতাম না, যদি না আওয়ামী লীগের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তিন-চার দিন আগে এরূপ পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট দু-তিনটি কথা না বলতেন। সৈয়দ আশরাফের কথা বিভিন্ন পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে। তার কথার সারবস্তু হলো তিনটি। প্রথম সারবস্তু, শেখ হাসিনাকে কোনো ধরনের বৈধ পন্থায় মতাচ্যুত করা যাবে না। দ্বিতীয় সারবস্তু, ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা যেন কেউ ঘটাতে না পারে তার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সতর্ক ও সাবধান হওয়া প্রয়োজন। তৃতীয় সারবস্তু; কিন্তু প্রকাশ্যে অনুচ্চারিত, বৈধ পন্থার অনুপস্থিতিতে অবৈধ পন্থাই মাত্র সামনে খোলা আছে; তবে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারীকে অবশ্যই কাজটি আওয়ামী লীগের সতর্ক চোখকে ফাঁকি দিয়ে করতে হবে। ফাঁকি যেন দিতে না পারে তার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন।


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কেন হঠাৎ করে এসব কথা বলতে গেলেন, এর ব্যাখ্যা একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন। তবে তার বক্তব্যের পর এ প্রসঙ্গে বহু আঙ্গিকের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এর সমালোচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি এবং তার পরিপ্রেতি ভিন্নরূপ। কোনো একটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী সংসারে গৃহকর্ত্রী হঠাৎ সন্দেহজনক আওয়াজ পেয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ঠাকুরঘরে কে?’ আসলেই একজন ব্যক্তি ঠাকুরঘরে ছিলেন, অবৈধভাবে এবং তিনি চুপ করে থাকলেই পারতেন। কিন্তু সেই অবৈধ ব্যক্তি চুপ করে না থেকে, নিজের নাম-ধাম না বলে বা পরিচয় না দিয়ে ভিন্ন রকমের একটি উত্তর দিলেন। তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি কলা খাই না’। প্রচলিত প্রবাদবাক্যটি হচ্ছে, ‘ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’।

এই কলামের পাঠক যারা তরুণ এবং বাংলা ভাষার প্রবাদ প্রবচনের সাথে সুপরিচিত নয়, এমন ব্যক্তিদের জন্যই ব্যাখ্যা দেয়া। ঠাকুর ঘর মানে হচ্ছে, সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো একটি পরিবারের সংসারে বা বাড়িতে একটি ঘর নির্দিষ্ট থাকত পূজা-অর্চনার জন্য। যেই ঘরে পূজনীয় দেবতার মূর্তি বা ‘বিগ্রহ’ স্থাপিত থাকে, সেই ঘরকে বলা হয় ঠাকুরঘর। পূজার সময় ফলমূল ব্যবহার হয় এবং পূজার পর ওই ফলমূল প্রসাদ হিসেবে ভক্তরা খেয়ে থাকেন। পল্লী বাংলার সাধারণ হিন্দু ঘরে কলা হলো সহজলভ্য ফলমূলের মধ্যে অন্যতম। এক ছড়ি কলা বা এক কাঁদি কলা সাধারণত ঠাকুরঘরে সব সময় রাখা হতো। গল্পে বর্ণিত সংসারে যিনি অবৈধভাবে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি বললেন, আমি কলা খাই না। কারণ তিনি সন্দেহ করলেন যে, গৃহকর্ত্রী কলার নিরাপত্তার জন্যই প্রশ্ন করেছেন ঠাকুরঘরে কে? তাই তিনি ওই উত্তরটাই দিলেন। বাংলা ভাষায় এই প্রবাদ এবং এর পরিপ্রেতি বর্ণনার পর, পাঠক সম্প্রদায়ের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এর সাথে সৈয়দ আশরাফের আলোচিত বক্তব্যটির সম্পর্ক কী? আমার বিশ্লেষণে মনে হয়, সৈয়দ আশরাফ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে সন্দেহ করছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটতেও পারে। তাই তিনি আগাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন, সম্ভবত দু’টি বিপরীত রাজনৈতিক মেরুর লোকজনের জন্য। এক রাজনৈতিক মেরু হচ্ছে তার নিজের দল আওয়ামী লীগ। আরেকটি রাজনৈতিক মেরু হচ্ছে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগবিরোধী অঙ্গন। আমি একটু ব্যাখ্যা দিই।

 


আওয়ামী লীগের প্রতি সম্ভাব্য বা অনুমিত সতর্ককরণের কাজটি দু’টি উদ্দেশ্যে করা হতে পারে। এক ধরনের উদ্দেশ্য হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরম ঘনিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ পরামর্শদাতাদের প্রতি। সেই পরামর্শদাতাদের উদ্দেশে সৈয়দ আশরাফ বললেন অনেকটা এরকম, ‘আপনারা মতা বদলের সব বৈধ পন্থা যেহেতু বন্ধ করে দিয়েছেন, সেহেতু অবৈধ পন্থার মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতেও পারেন। অথবা বৈধ পন্থা উন্মুক্ত করুন।’ আওয়ামী লীগের প্রতি সম্ভাব্য বা অনুমিত দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ যেরূপ আচরণ করেছিল, সেরূপ আচরণ আবার যেন ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ না করে সেই ব্যাপারে সাবধান থাকা। তা হলে স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ কী আচরণ করেছিল? প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘও দেয়া যায়, সংপ্তিভাবেও দেয়া যায়। আমি সংপ্তি উত্তর দিচ্ছি।

১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগ, প্রকাশ্যে এক রকম আচরণ করত এবং গোপনে আরেক রকম আচরণ করত। খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে কয়েকজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং বহুসংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্য গোপনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তারাও অনুভব করেছিলেন, কোনো প্রকারের বৈধ পন্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতা থেকে সরানো যাবে না। বিশেষত, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে, বাকশাল আইন ও বাকশালীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর। প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন ওই আমলের বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মোশতাক ও তার সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, রাজনৈতিক মতার পরিবর্তনের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতেই হবে। সেই অবৈধ পন্থা মানে রাজনৈতিক-সামরিক কুদেতা। রাজনৈতিক-সামরিক কুদেতা সম্পাদিত হওয়ার পরবর্তী-পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সন্ধান করে নিশ্চিত করা হয়েছিল। কুদেতা বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োজন ছিল। প্রায় ২০০ ওই আমলের পার্লামেন্ট সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যে, কু-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তারা যেন পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। কুদেতা বাস্তবায়নের জন্য অস্ত্র-শক্তি প্রয়োজন ছিল, তাই এরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক অফিসারের সাহায্য কামনা করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওই সব অফিসার তাদের অধীনস্থ ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্টসহ খন্দকার মোশতাক গংয়ের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আরো কিছু অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত সেনাবাহিনীর অফিসার নিজ নিজ কারণে ও আগ্রহে ওই কুদেতায় সম্পৃক্ত হয়ে যান। সব কিছুর ফল ছিল ১৫ আগস্ট ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা, তার পরিবার-পরিজন হত্যা এবং রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তন। ১৫ আগস্ট ’৭৫-এর সকাল ৬টার আগেই হত্যাকাণ্ড শেষ, দুপুর ১২টার মধ্যেই খন্দকার মোশতাক নতুন প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই পার্লামেন্ট সদস্যদের আনুগত্য প্রদর্শন এবং নতুন কেবিনেট গঠন করা হয়েছিল।


উপরের অনুচ্ছেদে আমি অতি সংপ্তি যে ব্যাখ্যা দিলাম, সেটি ছিল ১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কিত। ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগের অবস্থা কী সেটা বর্ণনা করা এই কলামের উদ্দেশ্য নয়; কিন্তু সম্মানিত সৈয়দ আশরাফ প্রকারান্তরে সেই সন্দেহজনক বা আতঙ্কজনক পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আওয়ামী লীগ ইতিহাসের অনেক কিছুকেই পরিবর্তিত বা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। এরা সাধারণত ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের জন্য ‘একদল সামরিক অফিসার’ অথবা ‘গুটিকয়েক সামরিক অফিসার’-এর কর্মকাণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করেন। ১৫ আগস্ট ’৭৫-এর পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের আচরণের প্রতি এবং ১৫ আগস্ট ’৭৫-এর পরবর্তী আওয়ামী লীগের আচরণের প্রতি সাধারণত ইঙ্গিত করেন না। আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে কোনো দিন আলোচনা করেনি একটি কথা।

কথাটি হলো, সেই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দু’টি ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কী নিয়মে বের হয়ে ধানমন্ডি ও বঙ্গভবন এলাকায় মোতায়েন হয়েছিল? যেসব পাঠক ঢাকা মহানগরের উত্তর অংশের সাথে পরিচিত, তারা অবশ্যই জানেন ঢাকা সেনানিবাস কোথায় এবং জাহাঙ্গীর গেট বা থার্ড গেট নামে গেটটি কোন জায়গায়? যারা জানেন না বা চেনেন না তাদের জন্য ইশারা হলো এরূপ। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দণি অংশে যে প্রধান গেট, সেটাকেই বলা হয় জাহাঙ্গীর গেট, তথা পুরনো এয়ারপোর্টের কাছে শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গেট। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্য আরো কয়েকটি গেট আছে উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিমে। ক্রমিক নম্বর অনুসরণ করলে জাহাঙ্গীর গেট হচ্ছে তৃতীয় বা থার্ড গেট, তাই এটাকে বলা হয় সাধারণ থার্ড গেট। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে এবং ১৫ আগস্ট শুরু হওয়ার পর ভোররাত ৩টার কিছু আগে বা কিছু পরে ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের সৈন্যরা এবং আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈন্যরা বের হয়ে যান। যখন বের হয়ে যান, তখন গেটে পাহারা অবশ্যই ছিল। যারা পাহারা দেন, তারা দুই ধরনের লোক। এক ধরনের হচ্ছেন পোশাকধারী মিলিটারি পুলিশ, আরেক ধরনের হচ্ছেন বেসামরিক পোশাকে সাধারণ মানুষের মতো বসে থাকা গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা।

গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এমন একটি গোয়েন্দা ইউনিট বা প্রতিষ্ঠান ছিল, যে ইউনিটটির সদস্যরা প্রত্যেকেই যে যেখানেই ডিউটি করুন না কেন, প্রয়োজন হলেই তার উপরস্থ অফিসার কমান্ডিং বা ওসি তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজরকে ফোন করতে পারতেন সরাসরি অথবা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে কথা বলতে পারতেন সরাসরি। ওই বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিটটির অধিনায়ক বা ওসিকে মতা দেয়া হয়েছিল যে, তিনি নিজের প্রয়োজন মোতাবেক যেকোনো সময় কারো মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি সেনাপ্রধানকে ফোনে বা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতেন। ওই আমলের সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন একজন দুই তারকা জেনারেল বা মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্কের অফিসার, অপর দিকে গোয়েন্দা ইউনিটটির অধিনায়ক বা ওসি ছিলেন মেজর র‌্যাঙ্কের। র‌্যাঙ্ক এবং অবস্থানের বিশাল গ্যাপ থাকা সত্ত্বেও মেজর সাহেবকে, মেজর জেনারেলের সাথে প্রত্য যোগাযোগের মতা দেয়া হয়েছিল একটি মাত্র উদ্দেশ্য সামনে রেখে। সেই উদ্দেশ্যটি হলো, যেন কোনো সময় নষ্ট না হয়, কোনো ঘটনা রিপোর্ট করতে গিয়ে। উদাহরণস্বরূপ ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ভোররাত আড়াইটা, ৩টা বা সাড়ে ৩টা এ রকম সময়ে থার্ড গেট দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি যেন থার্ড গেট থেকে সরাসরি মেজরকে জানানো যায় এবং মেজর যেন সরাসরি সেনাপ্রধানকে জানাতে পারেন। এত সব বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে যখন থার্ড গেট দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ট্যাঙ্ক এবং সৈন্য ঢাকা শহরের দিকে চলে গেল, সেই কথাটি গেটে অবস্থানরত গোয়েন্দারা মেজরকে জানিয়েছিলেন নাকি জানাননিÑ এই তথ্যটি গত ৩৯ বছরে আবিষ্কৃৃত হয়নি। অপর পরে ওই গোয়েন্দা ইউনিটটির অধিনায়ক বা অফিসার কমান্ডিং সংক্ষেপে ওসি, মেজর যে ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে জানাননি সেটা স্বীকৃত। ওই সম্মানিত মেজর জেনারেল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সাম্প্রতিক অতীতে এবং সেই ’৭৫ সালের মেজর সাম্প্রতিক সময়ে বা বর্তমানে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ আছেন। এত লম্বা বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগ যে ’৭৫-এর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছে কী লাগাচ্ছে না, সে কথাটি পাঠকের সামনে তুলে আনা।


আমি গত সাত বছর ধরে একজন রাজনৈতিক কর্মী। আমাদের দলের তথা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নীতিবাক্য (ইংরেজি ভাষায় মটো) হচ্ছে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। তবে সেই পরিবর্তনের মাধ্যম হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক। শান্তির প্রতি ও সংবিধানের প্রতি আমাদের বিশ্বাসের কারণেই আমরা সম্মানিত সৈয়দ আশরাফের কথায় উদ্বিগ্ন। আমরা বলতে, আমার মূল্যায়নে, ১৯ দলীয় জোট। আমরা সবাই শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পন্থায় পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এই কলামটি লিখছি ৯ জুন, ২০১৪ সোমবার সন্ধ্যার পর। ৯ জুন সোমবার সকালে জাতীয় প্রেস কাবে এবং বিকেলে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সদরে দু’টি ভিন্ন আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছি। প্রেস কাবের আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। গাজীপুরে আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, গাজীপুর জেলা ও গাজীপুর মহানগর শাখা। উভয় আলোচনা সভার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং গণতন্ত্র। আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৩তম শাহাদতবার্ষিকী উপল।ে ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ অতি প্রত্যুষে, চট্টগ্রাম মহানগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সরকারি সার্কিট হাউজের দোতলায় নিজ আবাসিক রুমের সামনে, কয়েকজন বিদ্রোহী সেনাবাহিনী অফিসারের সশস্ত্র আক্রমণে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম শহীদ হয়েছিলেন। সেই আক্রমণটি ছিল একটি কর্মের ফল। কর্মটি ছিল তৎকালীন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের জ্ঞাতসারে, কয়েকজন সেনা অফিসারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো বিদ্রোহ করেছিল। বিদ্রোহকে সামরিক পরিভাষায় ইংরেজিতে মিউটিনি বলে।

১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ একবার এবং ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ আরেকবার বাংলাদেশে রক্তাক্ত কুদেতা হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে চলমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির সামনে পড়ে। কমবেশি ১০ মাস পর তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান নিজে মতা দখল করেছিলেন। তিনি বিএনপি সরকারকে মতা থেকে অপসারিত করে, সামরিক শাসন জারি করে দেশ শাসন শুরু করেছিলেন। তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ শাসনকারী দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র। অতএব আমরা যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিক অথবা রাজনৈতিক কর্মী, আমাদের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি হতেই পারে যে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত বিএনপি এবং ১৯ দলীয় জোটকে দমন করার বা চাপের মুখে রাখার জন্য একটি কৌশল হিসেবেই কি সৈয়দ আশরাফ এরূপ আতঙ্কজনক ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী কথাগুলো বললেন?


রাষ্ট্রপতি হত্যা হলে দেশ যেমন তিগ্রস্ত হয়, যেকোনো একজন মানুষ নিহত হলে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন তিগ্রস্ত হয়। আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহের কারণ আওয়ামী লীগ সদস্য মারা যাচ্ছেন এটা যেমন দুশ্চিন্তার বিষয়, তেমনি সমান দুশ্চিন্তার বিষয় যে, আওয়ামী লীগের নির্দেশে অথবা আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে, সরকারি বাহিনী অথবা রাজনৈতিক ক্যাডার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম ও অপরহণ করছে এবং অপহরণের পর অনেককে হত্যা করছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য যেমন ১৫ আগস্ট বা ৩০ মে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুম হয়ে যাওয়া, অপরহরণ হয়ে যাওয়া, খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা এবং তাদের পরিবারের জন্যও গুম, খুন, খুনের তারিখগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সম্মানিত সৈয়দ আশরাফ শুধু ১৫ আগস্টের ব্যাপারে কথা না বলে, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যে প্রতিদিন একটি করে ১৫ আগস্ট ঘটে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কথা বললে ভালো করতেন। আমরা চাই দেশে শান্তি আসুক, মানুষের মনে শান্তি থাকুক, মানুষ নির্বিঘেœ নিরাপদে জীবনযাপন করুক। তার জন্য দেশে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সরকারের ওপরে ন্যস্ত। একে তো ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে মতা দখল করে আছেন, তার সাথে যদি অশান্তি সৃষ্টিকারী, জীবন হরণকারী, শান্তি বিনষ্টকারী হিসেবে চিন্নিত হন, তাহলে রাজনৈতিক জরিমানা বহুগুণে বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা।


লেখকঃঅবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!