DMCA.com Protection Status
title="৭

সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের ছক আঁকছিলেন নূর হোসেন!

Capture_10নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনের অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন আশ্রয় নিয়েছিলেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নরোত্তম সাহা ওরফে আশিকের কাছেই। আশিক ছাড়াও ভারতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো নূর হোসেনের।

সেখানে বসেই বেদখল হয়ে যাওয়া নারায়ণগঞ্জের অপরাধ সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের ছক আঁকছিলেন নূর। তবে তাদের পরিকল্পনার রঙিন বেলুন ফুটো করে দিয়ে বাংলাদেশি ও ভারতের দুটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গত শনিবার সন্ধ্যায় শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক, নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আটক করে। তবে নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগী ওয়াহিদুজ্জামান সেলিম এবং খান সুমনকে ১৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল বারাসাত আদালতের নির্দেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিন করে রিমান্ডে নেয় বাগুইহাটি থানা পুলিশ।

দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নূর হোসেনের ওই আড্ডায় নিয়মিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এলাকার দীপক ঘোষ ও কলকাতার বাপ্পা। নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সেলিম এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিকের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই আটককৃত দুই ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে নূর হোসেনের। সূত্রগুলো আরও জানায়, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর টানা তিন দিন রাজধানীতে এবং পরবর্তী তিন দিন বেনাপোল সীমান্তে স্থানীয় এক ব্যক্তির আশ্রয়ে আত্দগোপন করেছিলেন নূর হোসেন।

দেশের প্রায় সবকটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই ব্যক্তি নূর হোসেনকে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেন। তবে এরই মধ্যে দেশে থাকাবস্থায়ই নূর হোসেন যোগাযোগ করেন শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক এবং নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সেলিমের সঙ্গে। অতীতেও নূর হোসেন কলকাতায় গেলে তাদের আশ্রয় নিতেন। রঙ্গফুর্তিতে মেতে থাকতেন এসব সন্ত্রাসীর সঙ্গে।

গত শনিবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাংলাদেশের একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় কলকাতার কৈখালী এলাকা থেকে নূর হোসেনসহ মোট ছয়জনকে আটক করে ভারতীয় জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি দল। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত সেলিম নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের আস্থাভাজনদের মধ্যে একজন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ভারতে আত্দগোপন করেছিলেন। এদিকে নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের এক রাজনীতিবিদকে সাত খুনের মূল পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করেন নূর হোসেন। তিনি বলেছেন, ওই রাজনীতিবিদের কারণেই ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এখন আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। গ্রেফতারের পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে এমনই কথা বলেছেন নূর।

তবে গতকাল রোববার ভারতীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত আদালতের মুখে সাংবাদিকদের সামনে তিনি দাবি করেছেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। একই সঙ্গে ন্যায়বিচারের দাবিও জানান তিনি। নূর হোসেনকে আদালতে তোলার সময় কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আদালত চত্বরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। নূর হোসেনের সঙ্গে আদালতে তোলা হয় আরও দুই আসামি ওয়াহিদুজ্জামান সেলিম, খান সুমন বিত্তুকে।  জানা যায়,কলকাতায় গ্রেপ্তার নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার আসামি নূর হোসেনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখছে পুলিশ।

নূর হোসেনের কাছ থেকে জব্দ করা দুটি মোবাইল ফোন থেকে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলকাতার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনিবার গ্রেপ্তারের সময় নূর হোসেনের কাছে পাওয়া দুটি মোবাইল ফোনেরই সিম পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তিনি কতদিন ধরে কলকাতায় আছেন, তা আমরা নিশ্চিত হতে পারবো।

একই সঙ্গে এখানে এবং বাংলাদেশে তিনি কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাও জানা যাবে। এতে বাংলাদেশি অপরাধীদের এখানে কারা আশ্রয় দেয় শুধু তাদের সম্পর্কেই জানা যাবে না, বাংলাদেশে খুনের অভিযোগে তাকে যে খোঁজা হচ্ছিল সেটা নিশ্চিত হতেও আমাদের জন্য সহায়ক হবে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ সীমান্ত এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত নেটওয়ার্কগুলোকে চিহ্নিত করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, নূর হোসেনকে নিরাপদে অবস্থান করার সুযোগ কারা করে দিয়েছে, সেটা জানতে পারাটা হবে দারুণ একটা ব্যাপার।

, গত শনিবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ৮টার দিকে কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা কৈখালীর ব্লক-এ ইন্দ্রপ্রস্থ কমপ্লেক্সে পাঁচ তলার ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে তাকে গ্রেফতার করে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ)। ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারির পর দিলি্লর এনআইএর একটি বিশেষ টিম নূর হোসেনের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেয়। সর্বশেষ কলকাতায় তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তারা অভিযান চালায়। একটি রিভলভার ও গুলিসহ আটকের পর নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগীকে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে এনআইএ।

তবে পরবর্তীতে তাদের অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে ১৪ ধারায় গ্রেফতার দেখায় বাগুইহাটি থানা পুলিশ। থানায় দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় নূর হোসেনকে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের নাম বলেছেন বলে জানিয়েছে একটি পুলিশি সূত্র। পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের রাত কেটেছে বাগুইহাটি থানার গারদে। খাবার হিসেবে ছিল থানার রুটি-তরকারি এবং সকালে খেয়েছেন চা-বিস্কুট। সকাল ৯টার দিকে নূর হোসেনসহ বাকিদের মেডিকেল চেকআপের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

সকাল ১০টার দিকে তাদের নিয়ে আসার অল্প কিছুক্ষণ পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বারাসাত আদালতে। পরে আদালতের নির্দেশে তাদের আট দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পত্রিকাটি আরো জানায়, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক ও ভারতীয় নাগরিক বাপ্পার রেফারেন্সেই কৈখালীর ব্লক-এ ইন্দ্রপ্রস্থ কমপ্লেক্সে পাঁচ তলার ৫০১ নম্বর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নেন নূর হোসেন। বাসার মালিক দিলি্লতে অবস্থানকারী সীমা সিংকে বলা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য নূর হোসেন কলকাতায় এসেছেন।

এ সময়ের মধ্যে খুব একটা তিনি বাসা থেকে বের হননি বলে জানিয়েছে সূত্র। তবে নূর হোসেন অবস্থানের পর থেকে ওই বাসায়ই নিয়মিত আড্ডা বসত কলকাতা এবং এর আশপাশের শহরে অবস্থানকারী ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের পলাতক সন্ত্রাসীদের। সর্বশেষ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কঠোর গোপনীয়তায় মুক্ত হওয়া মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম খলিলও কলকাতায় গিয়ে ওই বাসাতেই উঠেছিলেন। ইব্রাহিম খলিল ও আশিক দীর্ঘদিনের বন্ধু। সেখান থেকে ইব্রাহিমকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন আশিক।

২০০৯ সালের ২৬ জুন কাওরানবাজারের এলসি ফারুক মোল্লা, আশরাফ আলী ও নূর ইসলাম জুয়েলকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যার পরদিন থেকে দেশ ছাড়ে আশিক। আশিকের নামে তিনটি হত্যামামলাসহ মোট ১৩টি মামলা রয়েছে। কলকাতায় আশিক সৌমেন খান এবং বিত্তু নামে পরিচিত। এদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহি:সমর্পণ চুক্তির আওতায় নূর হোসেনসহ গ্রেফতারকৃত অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

অবশ্য অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, পলাতক অপরাধীদের বিনিময়ের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে থাকা সমঝোতার আওতায়ও নূর হোসেনসহ অন্য যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদেরকে শিগগির দেশে ফিরিয়ে আনা হতে পারে। ইতোমধ্যে বিষয়টি অবহিত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!