ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বিএনপিকে নতুন করে গোছানো, সরকারবিরোধী কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা এবং দ্রুত নতুন জাতীয় নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক মহলের, বিশেষ করে ভারতের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সামনে রমজানে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ঈদের পর আন্দোলন শুরু করবে বিএনপি। জানা গেছে , সৌদি আরব, দুবাই, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ সফর করার কথা ছিল তারেক রহমানের। তবে আপাতত এ সফরসূচি স্থগিত করেছেন তিনি। মালয়েশিয়া থেকে তিনি লন্ডনে ফিরে গেছেন। রমজানে ওমরাহ করতে যাবেন সৌদি আরবে। একই সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ওমরাহ করতে যাবেন। সেখানে মা-ছেলের দেখা হওয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দলের একাধিক নেতার ওপর নাখোশ তারেক রহমান। তাই দল নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ আমলে নিতে আবার খালেদা জিয়াকে তাগিদ দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দলের একজন সম্পাদক ও একজন আইনজীবী নেতা লন্ডন ঘুরে এসেছেন। তাঁদের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার কাছে দলীয় কোনো কোনো নেতা সম্পর্কে কিছু সতর্কতামূলক বার্তাও দিয়েছেন তারেক। এতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও যাঁরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়েছে।
তারেক রহমান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ওই নেতাদের আর দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চান না তিনি। জিয়া পরিবার ও দলীয় নেতা-কর্মীদের আস্থাভাজন, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের আরেকটি তালিকাও করেছেন তিনি। ওই তালিকায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নির্বাহী কমিটির সদস্য সহ শীর্ষ নেতাদের কার কী ভূমিকা ছিল এবং এখন তাঁরা কে কী ভূমিকা রাখছেন সেসব স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার চারপাশে থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে যাঁরা বাধা দিয়েছেন তাঁদের বিষয়ও উঠে এসেছে।
বিশেষ করে গুলশান অফিসকেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তির বিষয়ে তারেক বিশেষ বার্তা দিয়েছেন। তারেকের পাঠানো বার্তায় এটি স্পষ্ট, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আসতে পারে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারেক রহমান দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। এরই মধ্যে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দলের বিষয়ে তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ারপারসনকে পরামর্শ দেবেন এটাই স্বাভাবিক।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও তারেক রহমানের মামলার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘একানব্বই সাল থেকে তারেক রহমান দলের সঙ্গে জড়িত। দলের প্রত্যেক নেতার বিষয়ে তাঁর ধারণা রয়েছে। বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকলেও তিনি দেশ ও দল নিয়ে ভাবেন। প্রতিদিন ইন্টারনেটে দেশের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। দেশের ভালোর জন্য আয়োজন করা বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেবেন বা মতামত দেবেন, এটাই স্বাভাবিক।’
কী ধরনের আন্দোলনের ছক কষছেন তারেক রহমান- এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির একজন আইনজীবী নেতা জানান, আন্দোলনের ধারা সব সময় একই। ব্যতিক্রম হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি প্রয়োগ করা। মূলত তা নিয়েই কাজ করছেন তারেক রহমান। এই নেতার দাবি, বিক্ষোভ-মিছিল, সভা-সমাবেশ, ঢাকা ঘেরাও, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ ইত্যাদি কর্মসূচিই থাকবে।
অক্টোবর পর্যন্ত মূলত নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চলবে। ঈদুল আযহার পর আন্দোলন তুঙ্গে নেওয়া হবে। এর মধ্যে দলকে সুসংগঠিত, নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হবে। চলবে কূটনৈতিক তৎপরতাও। বিএনপির আগামী দিনের কর্মসূচি কী জানতে চাইলে দলটির প্রভাবশালী একজন ভাইস চেয়ারম্যানও একই কথা জানান। তিনি বলেন, সহিষ্ণু কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন শুরু হবে।
এরপর লাগাতার হরতাল, অবরোধ, রাজধানী ঘেরাও এমনকি অসহযোগের ডাক দেওয়া হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে দল, জোট, মিত্র দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং প্রবাস থেকেও পরামর্শ আসবে। সূত্র মতে, ভারতে বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা মাথায় রেখে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে অন্তত ছয় মাস আগে থেকে কাজ শুরু করেছিলেন তারেক রহমান।
বিজেপির লন্ডন শাখার নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ভারতে লোকসভা নির্বাচনের আগেই বিএনপি সমর্থক কয়েকজন শিক্ষাবিদকে তারেক রহমান দিল্লিতে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন সরকারের সায় না থাকায় ভিসা পাননি তাঁরা। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী নেতা জানান, ওই শিক্ষাবিদরা শিগগিরই ভারত সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের সফর সফল হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারেক রহমানও ভারতে যেতে পারেন। তবে সব কিছু নির্ভর করবে মোদি সরকারের আন্তরিকতার ওপর।
এদিকে ইতিমধ্যে কমনওয়েলথ, ব্রিটেনের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনিয়র নেতা, মার্কিন সিনেটর, ভারতের বিজেপি, এমনকি মমতার তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে বা শিগগিরই করা হবে। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে তাঁদের কাছে দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তথ্যচিত্র ও প্রতিবেদনসংবলিত একটি করে বই দেওয়া হয়েছে।
এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, তারেকবিরোধী কর্মকাণ্ড, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন, বিনা বিচারে বিএনপি নেতাদের হত্যা-গুম, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রবাজি, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নানা রকম অপকর্ম, হুংকারসহ সব কিছুইর দেশি-বিদেশি পেপার কাটিং স্থান পেয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে, দল গোছাতে নতুন সংকটে পড়েছে বিএনপি। সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটির মধ্যে প্রায় ৪০টি চিহ্নিত করেছে দলের হাইকমান্ড। এর মধ্যে প্রায় ১৪টি জেলায় নতুন করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু হঠাৎ করে এ কর্মকাণ্ড থমকে যাওয়ায় জেলানেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নতুন কমিটি চেয়ে সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, ঢাকা মহানগর যুবদল, ছাত্রদল, কৃষক দল, মহিলা দল ও জাসাস পুনর্গঠনের কর্মকাণ্ড থেকে সরে এসেছেন খালেদা জিয়া। এতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দল পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। চিকিৎসার জন্য চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে ফিরে এলেই পুনর্গঠন কর্মকান্ড পুরোদমে শুরু হবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ১৪টিরও বেশি জেলায় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ কর্মকা- নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। দলের একাধিক সিনিয়র নেতার মতে, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয়। আর ঢাকায় লোক জড়ো করতে না পারার কারণেই সরকারকে টলানো যায়নি। তাই ব্যবস্থা নিতে হলে আগে কেন্দ্রীয় ও ঢাকার নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল জেলা কমিটি নয়, জেলায় যে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে তাদের উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন কমিটিও পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হবে। সম্মেলন করে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল থাকায় সম্মেলন করার কাজ শুরু করতে পারেনি অনেক আহ্বায়ক কমিটি।
সূত্রমতে, জেলা কমিটি পুনর্গঠনে খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের দিয়ে ৫৬টি দল গঠন করে দেন। এ নেতাদের বিভিন্ন জেলা সফর করে কমিটি পুনর্গঠন করতে বলা হয়। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট গিয়ে তার ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এর আগে একবার চট্টগ্রামে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার দুপরে প্রতিরোধের মুখে পড়েন।
উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ দুপরে তোপের মুখে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে ৫৬টি দলের জেলা সফর কর্মসূচি স্থগিত করে দেন খালেদা জিয়া। বিএনপির অবশ্য জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা ছাড়া বিকল্প নেই। দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা রয়েছে ৭৫টি। এর সব জেলা কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটির দাবি জানিয়ে গত ২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম জেলা প্রেসকাবে সংবাদ সম্মেলন করেন জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান, আবু বক্কর সিদ্দিক, সহ-সাধারণ সম্পাদক হাসিবুর রহমান হাসিব প্রমুখ।