দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ এক্সক্লুসিভঃ নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে উপনির্বাচনকে ঘিরে সাংসদ শামীম ওসমানের গোপন বৈঠকের খবর নিয়ে এখন নগরীর সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। নিজের অনুসারীদের সঙ্গে এ বৈঠকে তার বক্তব্যের অডিও ফাঁস হয়ে গেছে। অডিও ভয়েসে শোনা যায় নির্বাচনকে ঘিরে শামীম ওসমানের নির্দেশনা। অনুসারীদের তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন তার নির্বাচনী এলাকার (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) ২০-২৫ হাজার নেতাকর্মী বন্দর এলাকার কর্মীদের সহায়তা করতে উপস্থিত থাকবেন।
তার এ অডিও প্রকাশ পাওয়ায় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ওসমান পরিবারের আরেক সদস্য সেলিম ওসমানের প্রতিপক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বৈঠকের অডিও রেকর্ডটির কপি আমাদের হাতে রয়েছে। এই অডিওতে নির্বাচনে টাকা ছড়ানোর কথা শামীম ওসমান একাধিকবার বলেছেন।
উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ এসব অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, 'তদন্ত করে দেখা হবে।' শামীম ওসমানের অডিও রেকর্ড সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'এমন একটি কথা শুনেছি। কিন্তু এখনও কোনো রেকর্ড হাতে পাইনি।'অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, শামীম ওসমান নির্বাচনে দুই টাকা খরচ হলে তার ডাবল চার টাকা খরচ করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সবকিছুর ব্যবস্থাও তিনিই করবেন বলে নিশ্চিত করেন। ১৭ জুন একটি গোপন বৈঠকে বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে ওসমান পরিবারের অনুসারী নেতাকর্মীদের তিনি নির্বাচন-সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। ওই বৈঠকে শুধু ওসমান পরিবারের অনুসারীরাই উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ রশিদ এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম উপস্থিত ছিলেন। গোপন ওই সভাটি নারায়ণগঞ্জ বাংলাভবন কমিউনিটি সেন্টারে হয়ে থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জিজ্ঞেস করা হলে শামীম ওসমান তার বক্তব্যের অডিও সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি পাল্টা জানতে চান, কিসের অডিওর কথা বলছেন? বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পর তিনি বলেন, 'আমি গত ১৫ দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের কোথাও কোনো সভা-সমাবেশে যাইনি।' এর পর তিনি নিজে থেকেই বলেন, 'আচ্ছা, কেন্দ্র দখলের ভাবনাটাই আসছে কেন? নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে তো একজন প্রার্থীই ভোটের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। আর কেউ তো লড়াইয়ে নেই। কেন্দ্র দখল করার ভাবনা আসতে পারে নৌকা বনাম ধানের শীষে নির্বাচন হলে।' সবশেষে তিনি সমকালের কাছে অডিওটির একটি কপি পেতে চান। নিজের মোবাইল ফোন থেকে একটি ই-মেইল অ্যাড্রেস পাঠিয়ে বলেন, 'আমার গলা কে নকল করল, তা জানার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।' তবে অডিও মেইল করার পর তিনি কোনো উত্তর দেননি।
অডিওতে যা রয়েছে
অডিওতে শোনা যায়, শুরুতেই শামীম ওসমান বলছেন, 'জাতীয় পার্টিরটা জাতীয় পার্টি বুঝবে। বিএনপির লগে যদি কিছু লাইন করতে পারলে বিএনপিরটা বুঝব। আওয়ামী লীগেরটা আওয়ামী লীগ বুঝবে। আরেকটা দামি কথা বলি_ আপনি অ-নে-ক বড় নেতা, উনি অ-নে-ক ছোট নেতা। বড় নেতার সেন্টার বড় নেতায় বুঝায়া দেবেন, ছোট নেতারটা ছোট নেতায়। আপনের দৌড়াদৌড়ি কইরা অন্যেরটা বুঝানোর দরকার নাই।'
শামীম ওসমানের এ বক্তব্যের পর নেতাকর্মীরা সমস্বরে 'ঠিক' বলে হাততালি দেন। তার পর শামীম ওসমান আবার বলেন, 'বন্দরের মানুষের দরকার নাই মদনগঞ্জে, আর মদনগঞ্জের মানুষের কলাগাইচ্ছা যাওনের। কলাগাইচ্ছার মানুষ কলাগাইচ্ছারটাই করেন। হিজ হিজ, হুজ হুজ। যার যারটা সে সে করেন। নিজেরটা কইরা দিয়া যদি আপনে মনে করেন, আমার আরও ২/১টা সেন্টার হাতে আছে, এইটা কইরা দিয়া আমি আরও ১০ জায়গায় যাইতে পারমু, যান। কিন্তু এইটা কইরেন না, ওইটা করতে গিয়া আমারটা গেল গা। আমি আপনাগো হুকুম দিতাছি না, অনুরোধ করতাছি।'
এর পর শামীম ওসমান বলেন, 'এখন কথা হলো সেন্টার কমিটি। নির্বাচন কি বিনা পয়সায় করবেন_ নাহ। দুই টাকা খরচ হলে চার টাকা খরচ করেন। সমস্যা নাই। যা লাগে আমি বুঝুম। যা করতে অয় আমি করমু। ফকিরের মতো ইলেকশন করার দরকার নাই। বড়লোকের মতোই করেন। ন্যায়সঙ্গতভাবে নির্বাচন করার জন্য সেন্টার ওয়াইজ যা কিছু করার দরকার, সব করমু। কোথাও কোনো চাঁদাবাজি করবেন না। কারও থেইক্কা কোনো টাকা নেবেন না। আমার ভাইয়ের নির্দেশ, সে কারও থেইক্কা একটা টাকা নিতে দিব না এবং সে নিজেই চাঁদা দেওয়া মানুষ। আল্লায় তাকে তৌফিক দিছে দেওয়ার। এমনকি আমাকেও দিতে দিচ্ছে না সে।' তিনি বলেন, 'কেউ খবরাখবর নিতে বা গোয়েন্দাগিরি করতে আসছেন? ভাই আমার লগে গোয়েন্দাগিরি কইরেন না। কারণ, প্রত্যেকটা সেন্টারে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কর্নার থেকে তিনজন করে ছেলে পাঠাইছি। একজন করে আগামীকাল থেকে নিজাম পরিচয় করিয়ে দেবে। আর দুই জন থাকব। নির্বাচনের দিন আমার যে নির্বাচনী এলাকা আছে, সেখান থেকে ২০-২৫ হাজার লোক আসব আপনাদের সঙ্গে আপনাগো এলাকায় নির্বাচন করতে। যদি কন ২৫ হাজারে অইব না, তাইলে ৫০ হাজারে পাঠামু। ৫০ হাজারে না অইলে এক লাখ পাঠামু; চিন্তা কইরেন না। আমার ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ এবং সোনারগাঁ থেইক্কা এক লাখ লোক নিয়া আসা শামীম ওসমানের জন্য বড় কোনো ব্যাপার না।'
উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হয়েছেন ওসমান পরিবারের এক ভাই সেলিম ওসমান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব, সাবেক সাংসদ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পদত্যাগী আহ্বায়ক এস এম আকরাম।