দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনীতি কিংবা সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি বাংলাদেশে সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো নীরব কারণ। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিলেও এরই মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সংঘাত-সহিংসতার দৃষ্টান্ত দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।
স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিবছর বাংলাদেশের মোট স্থলভাগের ১৮-৭৫ ভাগ জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ প্রাণহানী, গৃহহীন হওয়া ছাড়াও হয় অর্থনৈতিক ক্ষতি। এরপর আবার, জলবায়ু পরিবর্তন আর সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থলভাগ তলিয়া যাওয়ার আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেবল জলমগ্নতা নয়, খরা, ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হচ্ছে নিয়ত।
পরিবেশবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বেড়ে যাবে সংঘাত-সহিংসতা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার মুখে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?যদিও বাংলাদেশ সরকার জলবায়ুকে কেন্দ্র করে সংঘাতের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে না।
বাংলাদেশর জলবায়ু পরিবর্তন স্ট্রাটেজি অ্যাকশন ২০০৯ তৈরি করার সময় জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র সংঘাতের বিষয়টি তোলা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে এটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যদি সমুদ্রর পানির উচ্চতা ৩ মিটার বৃদ্ধি পায়, তবে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১৭.৫ ভাগ সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যাবে। বাস্তুহারা ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে কয়েক লাখ মানুষ। বাংলাদেশকে হারাতে হতে পারে, অন্যতম বৃহত্তম প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনকেও।
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। যা ফসলি জমিকে ক্ষতি করবে, খাবার পানির সংকট তৈরি করবে। একই সময় বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একাংশ। দীর্ঘমেয়াদী খরায় নষ্ট হবে মানুষের ফসলের মাঠ, পানির উৎস ও মানব জীবন। জীবনধারণের জন্য এই দুই এলাকার মানুষ আশ্রয় নেবে শহরে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত অন্যান্য শহরগুলোকেও বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে তারা।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বাস্তুহারা এই মানুষরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কিভাবে বদলে দেবে তা নিয়ে গবেষণা, নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণের মতো কোন কাজই করছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গবেষক সওয়ার আহমদ ও কামাল হোসেন তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের চার কোটি মানুষকে বাস্তুহারা হতে হবে। আর বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অধিবাসন ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। যদিও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করা হয় না। মনে করা হয়, আর্থ সামাজিক কারণে এরা বাস্তুহারা হয়ে বড় শহরে গিয়ে উঠছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য নানান সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ নিজের স্থায়ী বাস ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। আর জলবায়ু উদ্বাস্তুদের চাপে এরইমধ্যে ত্রাহিদশা রাজধানী ঢাকার। প্রতিবছর ঢাকা শহরে হাজির হচ্ছে ৪ লাখের বেশি উদ্বাস্তু। যাদের চাপে ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। আর আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এই হার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার মানুষরা নতুন নতুন জীবিকার উৎস অনুসন্ধান করছেন। পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জড়িয়ে পড়ছেন সহিংসতায়। গবেষকরা ধারণা করছেন, কথিত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনাগুলোও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সংঘাত বেড়ে যাওয়ারই একটি দৃষ্টান্ত। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাস পযন্ত হিন্দুদের ওপরে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর রাজনৈতিকভাবে দেখানর চেষ্টা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। হিন্দুদের জমি ও সম্পদ দখলের জন্য এই সব হামলা হয়েছে বলেও উঠে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে।
সম্পদের সংখ্যালঘুদের উপর বাংলাদেশের এই হামলাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার সাথে তুলনা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সীমিত সম্পদের দখলদারিত্ব নেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে জাতিগত দাঙ্গা হয় রুয়ান্ডাতে। হত্যা করা হয় ১০ লাখের বেশি মানুষকে। সেই সময় রুয়ান্ডাতে শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্টাফ অফিসার নজরুল হুসাইন। যিনি হিন্দুদের সম্পদ দখলের উদ্দেশ্যে তাদের উপর হামলাকে রয়ান্ডার সংঘাতের সাথে তুলনা করেছেন। তাই তার ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও তেমন সংঘাতের ঘটনা ঘটতে পারে।