আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একযুগ ধরে লড়াই করছে। এখন প্রত্যক্ষভাবে সেই লড়াইয়ের সমাপ্তি টানার চেষ্টা করছে। তবে এ পর্যায়ে সেই লড়াইয়ের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যার প্রমাণ।
ধর্মকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বে চরমপন্থি তত্পরতার ইতিহাস খুব দীর্ঘ সময়ের নয়। একক নেতৃত্বের অভাবই মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থি মতাদর্শের উত্থানের মূল কারণ। মুসলমানদের সবশেষ কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে টিকে ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য। প্রথমে ব্রিটিশরা খেলাফত বিলুপ্তির উদ্যোগ নিলেও মুসলমানরা এর প্রতিবাদ করে। পরে দেশটির সামরিক কর্মকর্তা ও জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তাফা কামাল পাশা নিজেই খেলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। যাত্রা শুরু হয় প্রজাতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের। ওসমানী খেলাফতের পতনে মুসলিম বিশ্বে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিলুপ্তি ঘটে। মুসলমানরা হয়ে পড়ে অভিভাবকশূন্য।
খেলাফত বিলুপ্তির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই। সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ প্রাণঘাতী এই যুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষ নেয় তুরস্ক। সেই যুদ্ধে জার্মানি ও এর মিত্ররা পরাজিত হলে তার দায় তুরস্কের ওপরও পড়ে। অটোমান সাম্রাজ্যাধীন বিভিন্ন এলাকা মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলো দখল ও ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। তখন ফিলিস্তিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তত্কালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার বেলফোর ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিন ত্যাগের আগেই ব্রিটিশরা বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। ইঙ্গ-মার্কিন যোগসূত্রে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ‘ইসরাইল রাষ্ট্র’ প্রস্তাব গৃহীত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আরব মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কোনোভাবেই অবৈধ এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তারা মেনে নিতে পারেনি। ফলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চারবার ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আরবরা। বৃহত্ শক্তির সার্বিক সহযোগিতায় এসব যুদ্ধে ইসরাইল জয়লাভ করে এবং আরবদের অনেক ভুমি দখল করে নেয়। তখন চাপের মুখে আরব নেতাদের কেউ কেউ স্বাধীন ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। এতে আরব মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়ে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। যার শিকার হন আরব নেতারাও। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির জেরে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের হত্যাকাণ্ড তেমনই এক উদাহরণ। ফিলিস্তিনের হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম হয় এ কারণেই।
এদিকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। ফলে স্বাধীনতার জন্য বসনিয়া, চেচনিয়ার মতো অঞ্চলে সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্ম হয়। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মুসলমানদের সঙ্গে যুক্ত হয় সোভিয়েতবিরোধী এসব বিক্ষুব্ধ মুসলিম জনগোষ্ঠী।
ব্রিটিশদের কারণে ভারতবর্ষেও কিছু স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও দেশীয় কয়েকটি রাজ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না দিয়েই ব্রিটিশরা চলে যায়। যার মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যান। জাতিসংঘ গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যুর মীমাংসা করার প্রস্তাব নেয়।
কিন্তু আজ পর্যন্ত সে প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। কাশ্মীর ইস্যুতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার ভেটো প্রয়োগ করে ভারতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে কাশ্মীরসহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের ক্ষেত্রে দখলদারিত্বের নীতি গ্রহণ করে ভারত। এতে সেখানেও স্বাধীনতার জন্য ধর্মীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম হয়।
বিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসব ঘটনাপ্রবাহে মুসলমানরা হতাশ হয়ে যায়। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল শত শত বছর শাসনকারী জাতি হয়ে পড়ে সবচেয়ে নির্যাতিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সমরে একসময় যারা রাজত্ব করেছে, তারা হয়ে পড়ে সবচেয়ে ভগ্ন হূদয়ের জনগোষ্ঠী। মুসলমানরাও জাগতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সব আশা হারিয়ে পরলোকের দিকেই মনোযোগ দেয়। এর মধ্যে একাংশ শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতানির্ভর হয়ে পড়লেও অপর অংশ খেলাফত পুনরুদ্ধারে বেছে নেয় চরমপন্থা।
মুসলমানদের এই মানসিকতাকে কাজে লাগায় ধুরন্ধর ক্ষমতালোভী শক্তি। যাদের পেছনে ইন্ধন দেয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। স্নায়ুযুদ্ধের সময় রুশ-আফগান যুদ্ধে এমনই ধূর্ততার আশ্রয় নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যোদ্ধাদের এনে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানদের সহায়তা করে দেশটি। সোভিয়েতমুক্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা। তখন আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠিত হয়। রুশ-আফগান যুদ্ধ শেষে আফগানফেরত ‘মুজাহিদ’রা নিজ নিজ দেশে ফিরে ধর্মীয় উগ্রবাদী নীতি প্রচার করে।
ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হয় এই শতকের গোড়াতে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ বিমান হামলায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হন। কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে এজন্য দায়ী করে। এরপর তাদেরই এক সময়ের মিত্র বিন লাদেনকে ধরতে আফগানিস্তান আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় সেখানে তালেবান সরকারের পতন হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালের মার্চে বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অজুহাতে ইরাকে সামরিক হামলা চালায় ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী। মার্কিন আক্রমণের মুখে সামরিক একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের পতন হয়। এতে ইরাকে শিয়া, সুন্নী ও কুর্দি দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
২০০৮-০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ধীরে ধীরে লড়াই থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে তারা। আফগানিস্তান থেকেও চলতি বছরের শেষ
নাগাদ সৈন্য প্রত্যাহারের কথা রয়েছে। এক যুগের বেশি সময়ের এই যুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি কমেছে নাকি বেড়েছে— এই প্রশ্নটা বড় করে আসছে। আফগানযুদ্ধের সময় সন্ত্রাসবাদ পাকিস্তানেও ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ইতিমধ্যে পিপিপির সাবেক প্রধান ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। সব শেষ পাকিস্তানের করাচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে সন্ত্রাসী হামলা করা হয়। সেই হামলায় সুবিধা করতে না পারলেও এর চেয়ে ভয়াবহ হামলার হুমকি দিয়েছে তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) একটি অংশ।
এদিকে সম্প্রতি ইরাকে সুন্নী সশস্ত্রগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্টের (আইএসআইএল) তত্পরতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশটির কয়েকটি শহর দখল করে নেয় আল কায়েদা সমর্থিত এই সংগঠন। গত ১১ জুন সাদ্দাম হোসেনের শহর তিকরিত ও তেল শোধনের জন্য বিখ্যাত শহর বাজির নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। এর আগে ইরাকের ফালুজা ও রামাদি শহর নিয়ন্ত্রণে নেয় জঙ্গিরা। ইতিমধ্যে পশ্চিম সিরিয়া এবং মধ্য ইরাকের উল্লেখযোগ্য অংশ সুন্নী সশস্ত্রগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
দেশটির সেনাবাহিনী অস্ত্র ও পোশাক ফেলে শহর থেকে পালিয়ে যায়। অনেক সেনাসদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইরাকের শিয়া প্রধানমন্ত্রী নূর-ই আল মালিকির পক্ষে সুন্নী সশস্ত্রগোষ্ঠীকে দমন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিয়ারাও এর মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের এই ঘটনার সঙ্গে ইরানও সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। আমেরিকা সশস্ত্রগোষ্ঠীর উত্থানে নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করছে। ইতিমধ্যে কিছু সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে দেশটি।
সব মিলিয়ে ইরাকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এমনকি অবিভক্ত ইরাকের ভবিষ্যত্ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আফগানিস্তানেও মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শেষে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তালেবান ও আল-কায়েদার সশস্ত্র সদস্যরা হামলা চালাতে পারে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বলা যায়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই যুদ্ধ আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
বরং আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। শিয়া-সুন্নীর সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। আর সমগ্র এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে করেছে ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই ঝুঁকি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তাই এখন দেখার বিষয়।