বাবার হত্যা মামলার আসামিরাই অপহরণ করেছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর পারভীন আক্তারকে। মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশে তাকে হত্যা করে লাশ গুম করার পরিকল্পনা করেছিল অপহরণকারীরা।
নিখোঁজের একদিন পর হবিগঞ্জ থেকে উদ্ধার হওয়া কাউন্সিলর পারভীন আক্তার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
রোববার বেলা সাড়ে ১২ টায় গাজীপুর পুলিশ সুপার কার্যালয় মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল বাতেন বলেন, গত ১০ জুলাই রাতে অজ্ঞাত এক নারী মুঠোফোনে নারী কাউন্সিলর পারভীন আক্তারকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক বিরোধের অভিযোগ করে। পরদিন ১১ জুলাই এ ব্যাপারে সালিশের আহ্বান করে কাউন্সিলরকে দক্ষিণ পানিশাইল এলাকার রহিম আফরোজ ব্যাটারি কারখানার সামনে আসতে বলেন।
১১ জুলাই সকাল আটটার দিকে কাউন্সিলর অজ্ঞাত নারীর কথামত রহিম আফরোজ ব্যাটারি কারখানার সামনে যান। সেখানে অজ্ঞাত ওই নারী তার স্বর্ণালঙ্কার স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করতে কাউন্সিলরের কাছে জমা দেয়ার কথা জানিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় সমস্যার কথা বলেন। পরে তাকে সামান্য দূরে তার মাইক্রোবাসে বসে স্বর্ণালঙ্কার হস্তান্তর করতে চান। সেখানে কালো রঙের মাইক্রোবাসে উঠার পরই কাউন্সিলর (পারভীন আক্তার) তার বাবা হত্যার আসামি দুলাল হোসেন খান ওরফে দুলাল হাজী, সোহেল, জুয়েল এবং অজ্ঞাত তিনজনকে দেখতে পান। তারা তার মুখে চেতনানাশক পদার্থ ছিটালে দিলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।
এরপর শুক্রবার রাত ৯ টার দিকে তিনি নিজেকে একটি ঘরে দেখতে পান। অজ্ঞাতনামা তিন নারী তাকে পাহারা দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর মাইক্রোবাসে করে সেখান থেকে তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে দেখেন। ওই সময়ে মাইক্রোবাসে আগের সেই তিনজনকে দেখতে পাননি। তবে নতুন আরো তিনজনকে দেখতে পান।
শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার আউশকান্দি এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন এসডি মার্কেটের সামনে হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ লাগানো অবস্থায় কাউন্সিলর পারভীন আক্তারকে তারা ফেলে রেখে যায়।
এরপর এক ভ্যানগাড়ি চালক তাকে দেখে উদ্ধার করেন এবং পুলিশে সোপর্দ করেন। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গাজীপুর জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। গাজীপুর জেলা পুলিশ ১৩ জুলাই হবিগঞ্জ থেকে ভোর পাঁচটার দিকে গাজীপুরে নিয়ে আসেন। দুপুর সাড়ে ১২ টায় সংবাদ সম্মেলন শেষে কাউন্সিলরকে তার স্বামী মিনহাজুল ইসলামের কাছে তুলে দেন।
অপহরণ মামলা: নিখোঁজের ঘটনায় কাউন্সিলরের স্বামী ১২ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় বাদী হয়ে একটি অপহরণ মামলা (নং ৬০) করেন। ওই মামলায় গাজীপুর মহানগরের দক্ষিণ পানিশাইল এলাকার মৃত ফজর আলী খানের ছেলে দুলাল হোসেন খান ওরফে দুলাল হাজী (৫০), এমদাদ হোসেনের ছেলে সোহেল (২৫), জুয়েল (২২), আনিসুর রহমানের ছেলে রমজান (২২), আব্দুল আজিজের ছেলে রাসেল (২২), জালাল বেপারির ছেলে খোরশেদ (৪৫), তার স্ত্রী শাহিনা (৩৫), স্থানীয় মৃধাপাড়া এলাকার তৈজুদ্দীন মৃধার ছেলে মোশারফ (৫০) ও ঢাকার আশুলিয়া থানার কলতাসুতি এলাকার সামসু মিয়ার ছেলে আওলাদকে (২৬) আসামি করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়া হত্যা মামলা: ২০১১ সনের ২২ জুন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন কাউন্সিলর পারভীন আক্তারের বাবা মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়া। পরদিন ২৩ জুন সকাল ৬ টার দিকে দক্ষিণ পানিশাইল এলাকার পলাশ হাউজিংয়ের রাসেলের পরিত্যক্ত বাড়ির একটি কক্ষে চাঁন মিয়ার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের মেয়ে কাউন্সিলর পারভীন আক্তার বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় হত্যা মামলা (নং ৫৯, তারিখ ২৩.০৬.২০১১) দায়ের করেন। চিহ্নিত আট জনসহ অজ্ঞাতদের ওই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।
ওই মামলাটি জয়দেবপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম-৩ তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এজাহারভূক্ত আট আসামির মধ্য থেকে ফজলুল করিম দুলাল, রাসেল, খোরশেদ ও জুলফিকারের নামে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়।
বাবার মামলায় অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেন মামলার বাদী কাউন্সিলর পারভীন আক্তার। পরে আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
গাজীপুর জেলা সিআইডির পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, মামলাটি তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয়বার মামলাটির তদন্ত চলমান অবস্থায় মামলার বাদী কাউন্সিলর পারভীন আক্তার আসামি সোহেল, জুয়েল, রমজান ও সাগরকে এলাকাবাসীর সহায়তায় ধরে সিআইডি পুলিশে সোপর্দ করেন। সোহেল ও জুয়েল উচ্চ আদালত থেকে জামনি নেয়ায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মামলায় প্রথম তদন্তে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া সাগর ওরফে বিষ্ণু আদালতে চাঁন মিয়া হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সাগর এবং অপর আসামি রমজানকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। অন্যান্য আসামিরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
সিআইডির তদন্তে চাঁন মিয়া হত্যা মামলায় ১০ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের সম্ভাবনা রয়েছে। মামলার আসামি সোহেল, জুয়েলের কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, তারা চিহ্নিত খুনী।