ফিলিস্তিনের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি তাদের সমর্থন গুটিয়ে নিচ্ছে তখন নিজেদের অর্থনীতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে ইসরাইলকেই তাদের নতুন বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে চীন। আর এ কারণেই ইসরাইল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যবসা প্রত্যাহার করে নেয়া এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ইসরাইলের প্রতি সমর্থন সরিয়ে নেয়ার হুমকি সত্ত্বেও ইসরাইলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে চলেছে চীন। অপরদিকে ইসরাইলও নতুন বন্ধু হিসেবে নিজেদের আবাসন, হাইটেক, জাতীয় অবকাঠামো ও শিল্পখাতে চীনের জন্য বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার জন্য গড়ে ওঠা বিডিএস মুভমেন্টের অংশ হিসেবে ইসরাইলে বিনিয়োগ হ্রাস করছে ইউরোপ। কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি ইসরাইল সরকারের অধীনে নির্মিত বন্দর নির্মানের কাজ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহারও করে নিয়েছে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ফিলিস্তিনের সাথে শান্তি চুক্তি করার জন্য ইসরাইলকে সতর্ক করেছে। ঠিক এমন সময়ই সকল প্রকার মানবতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থে নিজেদের নতুন বন্ধু হিসেবে ইসরাইলকেই বেছে নিয়েছে চীন।
চীনাদের এই সুযোগ পাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে ইসরাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা হ্রাস। বিনিয়োগের স্বার্থে চীন নিজেদের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কাজটি করছে। চীনের এই নীতিতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। চীনের বিশাল বাজার, তার রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি তহবিল খরচ করে বহির্বিশ্বে বিনিয়োগের ইচ্ছা এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রভাব বিবেচনা করে বেইজিংয়ের জন্য সদর দরজা খুলে দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
এরই মধ্যে চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা ইসরাইলের শিল্পবাজারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। ইসরাইলের প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও কৌশলগত ব্যবসা খাতে অপ্রতিরোধ্য প্রবেশাধিকার পেয়েছে। তাছাড়া নিজস্ব অর্থনীতি্কে আধুনিকায়ন ও গতিশীল করতে চীনেরও এই সুযোগগুলোর প্রয়োজন আছে। এই অভাবগুলো পুরণ করার জন্য ইসরাইলই চীনের জন্য সবচেয়ে ভালো বাজার।
গত ডিসেম্বরে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং জি’র ইসরাইল সফরকালে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক যৌথ সংবাদ সম্মেলেন বলেন, আমাদের সামর্থ্য একে অন্যের পরিপূরক। চীনের আছে বিশাল শিল্পবাজার আর বৈশ্বিক প্রভাব এবং ইসরাইলের আছে সকল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান।
এছাড়াও ওয়াং’র সফরকালে নেতানিয়াহু ইসরায়েল সরকারের সহযোগিতার প্রসারের অংশ হিসেবে চীনকে ইসরাইলে রপ্তানীর ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাধা থেকেও দায়মুক্তি দিয়েছে। এমনকি নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ইসরাইলের ন্যাশনাল সাইবার ব্যুরোর আগামী বছর শুরু হতে যাওয়া প্রতিরক্ষা খাতে সাইবার নিরাপত্তা টিম গঠনের ক্ষেত্রে চীনকে যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি ইসরাইলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ এর মধ্য দিয়ে ইসরাইল সাইবার নিরাপত্তা জগতে চীনের মতো বিশ্বমোড়লের সাথে সম্পর্ক শুরু করতে সক্ষম হলো। শিল্পখাতে সাইবার নিরাপত্তায় বিশ্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এ প্রসঙ্গে ইসরাইলি এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ইসরাইলের বিনিয়োগ খাতে শীঘ্রই ইউরোপের জায়গা দখল করে নেবে চীন এবং চীন কিছু কিছু খাতে যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
চীন ও ইসরায়েলের এই ক্রমবর্ধমান উন্নতির আরেকটি নতুন ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে সুয়েজ খাল। ভৌগলিক কারণে ইসরাইল ও চীন উভয় দেশের কাছেই সুয়েজ খাল সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুয়েজ খালের ওপর চীনের নির্ভরতা কমাতে নতুন সমাধান খুঁজে দিচ্ছে ইসরায়েল। লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর সংযুক্ত করার জন্য লোহিত-ভূমধ্য রেল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে ইসরাইল। এই প্রকল্পটি ইউরোপে পণ্য রপ্তানি করার জন্য সুয়েজ খালের ওপর চীনের নির্ভরতা কমাবে। আবার ওই রেললাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের করার দায়িত্ব পেয়েছে চীনেরই কোম্পানি। সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য যে লোহিত-ভূমধ্যসাগর সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, তা যুগ যুগ ধরে চীনের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক রক্ষার কাজে আসবে।
এছাড়া ২০১১ সালে ইসরাইলের কৃষি রসায়ন খাতে বিনিয়োগ করে বড় বকমের লাভের মুখ দেখেছে চীন। তাছাড়া তেলআবিব এবং সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালেয়র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ইসরাইলের ন্যানোটেকনোলজিতেও প্রবেশাধিকার পেয়েছে চীন।
এদিকে ইসরাইল-চীনের বিদ্যমান সম্পর্কের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওয়াশিংটন। এই বিবেচনায় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে চীন–ইসরাইল সম্পর্ক কমানর জন্য ইসরাইলকে বেশ গুরুত্বও দিচ্ছে মার্কিন সরকার। অথচ ওয়াশিংটনের ঘোর বিরোধীতা সত্ত্বেও চীনের সাথে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা সম্পর্কের অংশ হিসেবে চীনের কাছে ১.১ বিলিয়ন মূল্যের ফ্যালকন বিক্রি করেছে ইসরাইল।
এইভাবে নৈতিকতার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেও নিজেদের লাভ বুঝে নিবে চীন।এর ফলস্বরূপ, ফিলিস্তিনের ওপর হামলার বন্ধ করতে কোন রকমের আন্তর্জাতিক চাপই আর বোধ করবে না ইসরাইল।