দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আসাম রাজ্যে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশী শরণার্থীদেরকে স্থায়ী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছে আসামের রাজ্য সরকার। কিন্তু এরইমধ্যে সরকারের এই সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও যে কোন মূল্যে তা ঠেকানোর সিদ্বান্তও নিয়েছে আসামের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৌয়ের মন্ত্রীসভা গত ১৬ই জুলাই বাংলাদেশী শরণার্থীদেরকে স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার এই সিদ্বান্ত নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বাংলাদেশীই ভারতের আসামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পার হলেও তাদের অনেকেই আর আসাম থেকে ফিরে আসেননি। কিন্তু মানবিক কারণে আশ্রয় নেওয়া এসব নাগরিকদেরকে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছে। সেদিক বিবেচনা করে তাদেরকে স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছে আসামের রাজ্য সরকার।
আসাম সরকারের এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদে অল আসাম স্টুডেন্টস ই্উনিয়ন (এএএসইউ) আসামের গোলাগাট জেলায় তরুণ গগৌয়ের কুশ পুত্তলিকা দাহ করেছে। আসাম রাজ্যের মন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মার কাছে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা তাদের প্রতিবাদ বিবেচনা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছে।এছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা আসামের নওগা, বনগাইগাও, জোড়হাট ও নালবাড়ী জেলায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে জোড়হাট জেলা এএএসইউ’র উপদেষ্টা বীরেন সাইকিয়া বলেন, জনগণের মতের বিরুদ্ধে ও সংবিধান বহির্ভূত এ সিদ্বান্ত মন্ত্রীসভা নিতে পারে না। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রীসভার ১৮ সদস্যের নেয়া এই সিদ্ধান্তের জবাব ক্ষমতাসীন দল আগামী নির্বাচনে সময় পাবে।
ধুবরী জেলা এএএসইউ’র সম্পাদক পুলকেশ রায় ব্যাপারী বলেন, গৌরীপুর, গোলকগঞ্জ, শালকোচা ও বিলাসীপাড়া, বহলপুর জেলায়ও সরকারের এ সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। তেজপুর জেলা এএএসইউ নেতাকর্মীরা বলেন, গগৌকে এই্ সিদ্বান্তের খেসারত দিতে হবে। এছাড়া তারা ‘তরুন গগৌ হায় হায়’, ‘আসাম সরকার হায় হায়’, ‘বাংলাদেশী গো ব্যাক’ ইত্যাদি বলে শ্লোগান দেন।
১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ মার্চ ১৯৭১ এর পরে যেসব লোক অবৈধভাবে আসামে প্রবেশ করেছে তাদেরকে প্রত্যার্পণ করা হবে। বাংলাদেশী শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে গত ৬ বছর যাবৎ আন্দোলন করে আসছে ‘এএএসইউ’। তারা দাবি করেছে, তরুন গগৌ ২০১৬ সালের রাজ্য সরকার নির্বাচনে ভোট ব্যাংক তৈরীর জন্য বাংলাদেশীদের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এএএসইউ’র উপদেষ্টা সমুজ্জল ভট্টাচার্য্য কলকাতা থেকে প্রকাশিত টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৌ ২০১১ সালে আসামের সংসদ নির্বাচনের আগে বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। কিন্তু ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর কংগ্রেস তার পুরোনো ভোটের রাজনীতির খেলায় মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, শরণার্থীরা হিন্দু নাকি মুসলিম তা বড় বিষয় নয়। কারণ আসাম চুক্তিতে ১৯৭১ সালে যারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে।
ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, আসাম চুক্তিতে বিশেষ বিবেচনায় ২৪ মার্চ ১৯৭১’র পূর্বে যেসব বাংলাদেশী আসামে এসেছে তাদেরকে আসামী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই সময়ের পরে যারা অবৈধভাবে আসামে প্রবেশ করেছে তারা শরণার্থী হিসেবেই স্বীকৃত হবে। এখন তারা হিন্দু বা মুসলিম যাই হোক, আসাম কেন অতিরিক্ত বাংলাদেশীদের বোঝা বহন করবে? যদি আসাম সরকার এসব নিয়ে চিন্তিত হয় তবে কেনো তারা আসামের প্রকৃত অধিবাসীদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে না? সমুজ্জল ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, আমরা এমন আসামের জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্বান্ত মেনে নিব না। কারণ এটা আসাম চুক্তি বিরোধী।
এএএসইউর সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার গগৌ বলেন, বিদেশী শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার নামে সরকারের এই ধরণের সিদ্বান্ত জনগনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করবে।
এছাড়া কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির( কেএমএসএস)নেতাকর্মীরাও আসামের দিসপুরে সচিবালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। সমাবেশে তারা দাবি করেছে তরুণ গগৌর সরকার আসামকে বাংলাদেশীদের শরণার্থী শিবিরে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। তাছাড়া কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির নেতাকর্মীরা সরকারের এই সিদ্বান্ত প্রত্যাহার করার দাবিতে সচিবালয় এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে পুলিশ সমিতির প্রকাশনা সম্পাদক ধৈর্য কনোয়ারসহ ৫ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে।
অন্যদিকে বনগাঁও জেলা আসাম জাতীয়তাবাদী যুব ছাত্র পরিষদও (এজেওয়াইসিপি) জেলা পরিষদের সামনে তরুন গগৌর কুশ পুত্তলিকা পুড়িয়েছে। এজেওয়াইসিপি’র বনগাঁও জেলা সভাপতি ব্রজেন বড়ুয়া বলেন, জনগণের আকার ঠিক না করে সরকারের এই সিদ্ধান্ত আসামের প্রকৃত নাগরিকদের অধিকার ক্ষুন্ন করবে।
অল কোচ রাজবংশী স্টুডেন্টস ইউনিয়নের(একেআর এস ইউ) নেতা বিশ্বজিৎ রায় বলেন, এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে যারা তাদের নিজের জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না তারা বিদেশী শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার ওকালতি করছে।
অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের(এএএমএসইউ) সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিমও এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। তিনি বলেন আমার দল আসামে ১৯৭১ সালে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি।
অল বুদোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এরিয়া ডিস্ট্রিক্ট(বিটিএডি) মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিটিএইডর ব্যারেজ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা মাত্র।
অন্যদিকে এআইইউডিএফ ও বিজেপি কোনো বিবৃতি দেয়ার আগে আলোচনায় বসার সিদ্বান্ত নিয়েছে।
এআইইউডিএফ’র সাধারণ সম্পাদক হাফিজ বশির আহমদ কাশেমী বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এই নিয়ে আমরা গভীর পর্যালোচনায় বসছি।আশাকরি আমাদের নেতা বদরুদ্দীন আজমল আগামীকালের মধ্যেই দলের পক্ষে বিবৃতি উপস্থাপন করবেন।