আইন সংশোধন করে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করার সুযোগ হাতে রাখার উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরের মাসেই, গত ফেব্রুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংশোধিত আইনটি চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের প্রস্তাব করা আছে।
দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ২০১৪ শিরোনামে এই সংশোধিত আইনের খসড়ায় রাষ্ট্রবিরোধী ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে সংবাদপত্র বন্ধ করার বিধান রাখা হয়। ১ জুলাই প্রথম আলোয় ‘সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে ফের বিতর্কিত আইন’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশিত হয়।
ওই দিন থেকেই তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলে আসছেন, এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তিনি অবগত নন। তাঁর মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কিছু জানে না।
তবে আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তথ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে গোপনে অনেক দূর এগিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে প্রথমে আট সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটি আইনের খসড়া তৈরির জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরকে (ডিএফপি) দায়িত্ব দেয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন যুগ্ম সচিব, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, ডিএফপির মহাপরিচালক, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক), আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একজন করে প্রতিনিধি।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কমিটির প্রথম সভা হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। সভায় ‘দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৮ মার্চ ডিএফপি থেকে সংশোধনীসহ আইনের খসড়াটি তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান ডিএফপির সাবেক মহাপরিচালক ও কমিটির সদস্য এ কে এম শামীম চৌধুরী। তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব। ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভায় খসড়ার ওপর আলোচনা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মূল আইনটি যেহেতু ইংরেজিতে আছে, তাই যুগোপযোগী করার কাজটিও ইংরেজিতে করা হবে।
খসড়ায় বলা হয়, রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী যেকোনো অভিযোগে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করতে পারবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তবে এটা কার্যকর করবেন তথ্য মন্ত্রণালয় বা আদালত। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। আদেশ দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ভুক্তভোগী প্রেস আপিল বোর্ডে আপিল করতে পারবে।
মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গত সোমবার প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘কর্মকর্তাদের দিয়ে গঠিত কমিটি কী সুপারিশ করেছে, তা বলতে পারব না। তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধবিষয়ক আইন প্রণয়নের কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’
এমন আইন তৈরির বিষয়ে তিনি জানেন না—এই মর্মে আগে কয়েক দফা দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যা কিছু হয়েছে, তা কর্মকর্তা পর্যায়ে। খসড়াটি আমরা দেখিনি। তাই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
তবে তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন কোনো খসড়া মন্ত্রণালয়ে আসার কথা তিনি জানেন না।
১৯৭৩ সালের প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস আইনটি সংশোধন বা এতে রাষ্ট্রদ্রোহ বা ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করতে এ পর্যন্ত কোনো মহল থেকেই দাবি তোলা হয়নি। এই উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের বাইরে কেউ যুক্ত নন।
স
ম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ঢাকার জেলা প্রশাসকের প্রস্তাব থেকে প্রথম বিষয়টি জানা যায়। সম্মেলনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তও ছিল। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এটা ছিল একধরনের কৌশল, যাতে মনে হয় সরকারের উচ্চপর্যায় নয়, প্রস্তাবটি মাঠ প্রশাসন থেকে এসেছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আগে বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। ফলে মন্ত্রণালয় তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং এমন উদ্যোগ নেই বলে জানান।
দীর্ঘদিন ধরে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিল-সংক্রান্ত এই ধারা দেশের সংবাদপত্রশিল্পে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ছিল। এই ধারাবলে ১৯৭৪ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হতো। সংবাদপত্রসেবীরা এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও দলীয় কোনো সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী এই ধারা বাতিল করে।
কিন্তু সংশোধিত আইনের ২২ ধারায় ‘প্রমাণীকরণ বাতিল’ শীর্ষক ১(চ) উপধারায় বলা হয়েছে, সংবাদপত্রে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মর্মে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে তিনি ঘোষণাপত্রের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবেন। সদ্য শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনের কার্যপত্রেও এই দুটি বিষয় উল্লেখ আছে। তবে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের কার্যপত্রে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ও ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ শব্দগুচ্ছ উল্লেখ থাকলেও মন্ত্রণালয়ের খসড়া আইনে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ এবং ‘ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত’ কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রস্তাবের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের করা খসড়া সংশোধনীর মিল রয়েছে।
আইনের ১(ঙ) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ডিএফপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সংবাদপত্রের প্রকাশক বা সম্পাদকের শর্ত অনুযায়ী শিক্ষাগত বা সাংবাদিকতার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থাকলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পত্রিকার প্রমাণীকরণ বাতিল করতে পারবেন।
জানতে চাইলে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরনের সংশোধন করার দাবি কেউ তোলেনি। এমন পদক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। এটি মেনে নেওয়া হবে না।
সংবাদ মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হলে তথ্যমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে মোটেও অবগত নন বলে বক্তব্য দেন। এ নিয়ে ২ জুলাই জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সমালোচনা করা হয়। ৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও এমন উদ্যোগ না নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে।
নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী গঠিত একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের প্রকাশনা আইন এবং চুয়াত্তরের বিশেষ ক্ষমতা আইনের তিনটি ধারা সংশোধন করা হয়। এর ফলে সাংবাদিক সমাজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
আইন সংশোধনের উদ্যোগের বিষয়ে রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঠান্ডা মাথায় নেওয়া এ উদ্যোগ খুবই উদ্বেগজনক। সাংবাদিক সমাজ এটা কখনো মেনে নেবে না। তিনি বলেন, যখন কোনো সরকারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই গণমাধ্যম হরণ বা কুক্ষিগত করার চেষ্টা লক্ষ করা যায়।