দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ হাসপাতালে সন্তান প্রসব করে নবজাতক ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার নিঃসন্তান নারী বেলি আক্তার রহিমা। অনেক চিকিৎসার পর কয়েক মাস আগে তিনি গর্ভবতী হন। এলাকাবাসী জেনেছেন সেই কথা। জেনেছেন রহিমার স্বামী সোনা মিয়াও।
সন্তান প্রসবের জন্য স্ত্রী হাসপাতালে গেছে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে। এর একদিন পর ফিরেছে এক ছেলে সন্তান কোলে নিয়ে। ঘরে ছিল উৎসবের আমেজ।
তবে র্যাবের এক অভিযানে উলোট-পালট হয়ে গেল সব! ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে গত ২১ আগস্ট চুরি হওয়া নবজাতক শিশু এখলাছকে নিয়ে এমনই নাটক সাজায় শিশু চোর রাশেদা খানম পারভিন ও শিশু ক্রেতা রহিমা।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর তারা জানান, ৩৯ হাজার টাকার বিনিময়ে এখলাছকে রহিমার হাতে তুলে দেন পারভিন। আর সন্তান প্রসবের কথা বলে স্বামী সোনা মিয়াসহ, অন্যান্য স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রতারণা করেন তারা। এ পরিকল্পনা ছিল শিশু চুরিতে ‘অভিজ্ঞ’ পারভিনের।
দৈনক প্রথম বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে দুজন জানান, তারা কীভাবে এখলাছকে চুরি করেন এবং কীভাবে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখেন।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, পারভিন পেশাদার শিশু চোর। ধাত্রী বিদ্যায় পারদর্শী পারভিন রোগী সেজে ঢামেক হাসপাতাল থেকে শিশুটি চুরি করেন। এর আগেই রহিমার সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী ছেলেকে তার হাতে তুলে দেন। কখনো অবৈধ গর্ভপাত ঘটিয়ে বেঁচে থাকা শিশুকে বিক্রি করেন পারভিন। আবার কখনো প্রসবের পর সন্তান মারা গেছে এমন মিথ্যা বলে শিশু চুরি করে বিক্রি করেছেন।
প্রাথমিকভাবে পারভিনের বিরুদ্ধে পাওয়া এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পারভিন এ প্রতিবেদককে জানান, তার বাসা গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার সোনিয়া গার্মেন্টের পাশে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। ১৬ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। ধাত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি একটি ফার্মেসিও দিয়েছেন।
পারভিনের দাবি, স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি সন্তান নিয়ে রহিমাকে দেয়ার কথা ছিল তার। তবে কয়েকমাস পর ওই ব্যক্তি সন্তান দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে তিনি ঢামেকে গিয়ে শিশু চুরি করেছেন। এ বিষয়টি রহিমাও আগে জানতো।
তবে রহিমা বলেন, ছয় বছর আগে গাজীপুরের বোর্ডবাজারের কলমেশ্বর বটতলা এলাকার সোনা মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের কোনো সন্তান নেই। এ কারণে স্থানীয় একজনের পরামর্শে পারভিনের কাছে যান তিনি। পারভিন গোলাম নামে একজনের কাছ থেকে বাচ্চা এনে দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নেন। সাত-আট মাস আগে নেন ২১ হাজার টাকা। পরে মেডিকেলের খরচের কথা বলে এক বার আট হাজার ও আরেকবার ১০ হাজার টাকা নেন। ৩৯ হাজার টাকা নেয়ার পর পারভিন জানান ওই ব্যক্তি বাচ্চা দিবে না। এরপর পারভিন তাকে ঢামেক থেকে বাচ্চা এনে দেয়ার কথা জানান।
রহিমা জানান, পারভিন তাকে গর্ভবতী বলে প্রচার করতে শিখিয়ে দেন। কয়েকমাস আগে রহিমা তার স্বামীকে জানান, তিনি গর্ভবর্তী হয়েছেন। স্বামী সোনা মিয়াও এ কথা বিশ্বাস করেন। গত ২১ আগস্ট প্রসব করানোর জন্য হাসপাতালে যাচ্ছেন বলে পারভিনের বাড়িতে গিয়ে থাকেন রহিমা। পরদিন সকালে শিশু এখলাছকে নিয়ে বাসায় ফিরে স্বামী ও আশপাশের সবাইকে জানান, এখলাছ তার সন্তান।
চুরি করার সাত দিনে পারভিন ও রহিমার কাছে থাকা অবস্থায় ঠিকমতো খাবার খায়নি এখলাছ। রহিমা জানান, পারভিন তাকে একটি ল্যাকটোজেন (শিশুখাদ্য) কিনে দেন শিশুকে খাওয়ানোর জন্য। তবে এখলাছ এ ফুড সাপ্লিমেন্টারি খেতে চাইছিল না। সারাদিন সে কান্না করত। কোলে নিলেও এ কান্না থামতো না। এ জন্য প্রতিবেশীরাও নানান প্রশ্ন করত রহিমাকে।
র্যাব-৩-এর উপ-অধিনায়ক মেজর মহিউদ্দিন দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে জানান, ঢামেক থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে র্যাব। এরপর রেজিস্টার দেখে হাসপাতালে আসা পারভিনের ব্যাপারে তথ্য পায়। একই সঙ্গে অন্যান্য কিছু তথ্যও সংগ্রহ করে তদন্তকারীরা। পরবর্তীতে র্যাবের একটি চৌকস দল পারভিনের অবস্থান শনাক্ত করে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘পারভিন ধাত্রী বিদ্যায় পারদর্শী। বোর্ডবাজার এলাকায় তার একটি ফার্মেসির ব্যবসাও আছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, অবৈধ গর্ভপাত ঘটিয়ে সন্তান বেঁচে থাকলে ওই নবজাতক বিক্রি করেন পারভিন। আবার কখনো জীবিত সন্তানকে মৃত বলে ঘোষণা করে সে নবজাতককেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন। নিঃসন্তান নারীরা তার কাছে ছুটে গেলে তাদের এভাবে টাকার বিনিময়ে সন্তান বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে র্যাব।’
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গত ২০ আগস্ট ঢামেক হাসপাতালে জমজ সন্তান জন্ম দেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কাওছার হোসেন বাবুর স্ত্রী রুনা আক্তার। ওই ওয়ার্ডে গিয়ে রাশেদা খানম পারভিন বলেন তার এক আত্মীয়ের তিনটি সন্তান হয়েছে। তিনি আইসিইউতে আছেন। এভাবে সর্ম্পক স্থাপন করে রুনার সন্তানকে খাবার খাওয়ান এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ২১ আগস্ট কান্না থামানোর কথা বলে কৌশলে একটি শিশু নিয়ে পারভিন সটকে পড়েন। এ ঘটনার একদিন পর গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার সোনা মিয়ার স্ত্রী বেলি আক্তার রহিমার কাছে ওই শিশুটি হস্তান্তর করেন। এর বিনিময়ে রহিমার কাছ থেকে তিনি ‘৪০ হাজার’ টাকা নেন। সন্তান দেয়ার এ চুক্তি হয় সাত-আট মাস আগে।
এদিকে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, শিশু চুরির ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই নারীকে আদালতে হাজির করা হবে। তাদের ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বুধবার রাতে গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে নবজাতক উদ্ধারের পর বৃহস্পতিবার সকালে বাবু-রুনা দম্পতির কোলে তাদের এখলাছকে তুলে দেয় র্যাব। এ সময় খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন নবজাতকের মা-বাবা। জমজ দুই সন্তান কোলে নিয়ে তারা গণমাধ্যম ও র্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তারা জমজ বড় ছেলেটির নাম রেখেছেন ইয়াছিন হোসেন। এ দম্পতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লার বাসিন্দা।