দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেছে সরকার সমর্থক বিডিনিউজ২৪ ডট কম। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে দেশীয় খলনায়ক জামায়াত-বিএনপি আর যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান-সৌদি আরবকে বিদেশী খলনায়ক হিসেবে দেখান হয়েছে।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উৎস হচ্ছে এক ভারতীয় গোয়েন্দার ‘কাল্পনিক’, বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন রিপোর্ট। বর্তমান সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাসাভাসা জানা-শোনা থাকলে যে কেউই এমন একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কল্পনা করে ফেলতে পারেন। কিন্তু যতই গভীরে যাওয়া যাবে, ততই প্রকাশ পাবে ভিন্ন বাস্তবতা, যার সাথে বিডিনিউজ২৪ ডট কমের প্রকাশিত এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খাপ খায় না। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বিডিনিউজ২৪ ডট কমের রিপোর্টটি বেমালুম ভুলে গেছে, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের নিত্যদিনের সাহসিক ভূমিকা।
বিভিনিউজ২৪ ডট কমের রিপোর্টটি পড়লে যে কারওর মনে হতে পারে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিভাগ যেন একেবারেই অকার্যকর। বাংলাদেশ সরকারের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিভাগ প্রতিনিয়ত কি ভূমিকা পালন করছে, কথিত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে গোয়েন্দাদের কি ভূমিকা তা তুলে ধরার কোন প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি পত্রিকাটি।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি ও বাস্তবতা
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাংলাদেশে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রেরও মনোভাবও নতুন নির্বাচনের পক্ষে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে সরিয়ে দিতে মার্কিনিরা অর্থ ব্যয় করেছেন। মার্কিনিদের এই তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জড়িত রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে ষড়যন্ত্রের সক্রিয় ক্রীড়ানক হিসেবে দেখান হয়েছে, বাস্তবতা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের গভীর আশঙ্কা ছিল- সবদলের অংশগ্রহণে সংসদ নির্বাচন ছাড়া অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে বাংলাদেশ। দেখা দেবে রাজনৈতিক গোলযোগ। এমনকি ঘটে যেতে পারে জঙ্গীবাদের উত্থান।
কিন্তু হবে হবে করেও রাজনৈতিক গোলযোগ এড়িয়ে চলছে বাংলাদেশে। ঈদুল ফিতরের পর সরকারের পতনের আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরুতেই মিলিয়ে গেছে। ‘ভেঙ্গে পড়ছে’ জামায়াতের চেইন অব কমান্ড। রাজনীতির বোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, সহসাই দেশে এসে কঠোর রাজনীতিতে তারেক রহমানের ফেরার লক্ষণই নাই। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একসময় মারদাঙ্গা অবস্থান নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু কোন রকমের ‘ঘটনা-দুর্ঘটনা’ ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে বন্ধু বলে ঘোষণা দিয়েছেন হেফাজতের আমীর আল্লামা শফী। এইভাবে রাজনীতির প্রকাশ্য চিত্রটি কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের আশঙ্কার প্রতি সুবিচার করেনি। ফলে, বারবার আগাম নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েও সুবিধা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
একই রকম অবস্থা ছিল দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও। সবদলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভারতবিরোধিতাও শুরু করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই তাদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। সফল হয় ভারতের কূটনীতিক তৎপরতা। এইভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র নয়, ভারতই প্রধান ক্রীড়ানকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
জামায়াত-বিএনপি প্রসঙ্গ
বর্তমান সরকারকে উৎখাত ষড়যন্ত্র নিয়ে কোন প্লট বানাতে দিলে, যে কেউ প্রথমে জামায়াত-বিএনপির নাম লিখবেন। এর জন্য গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। গোয়েন্দা হতে হয়, সরকার উৎখাতে জামায়াত-বিএনপির শক্তি-সামর্থ্য যাচাই করতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজ্যসভায় তৃণমূলের এমপি আহমেদ হাসান ইমরান এবং টেকনাফ থেকে ভারতে পাড়ি জমানো মাওলানা আসিফ খান গত ছয় মাস ধরে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন। “আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও তাদের কর্মীদের হত্যা এবং জন অসন্তোষের মাধ্যমে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই মূল পরিকল্পনা।”
জামায়াত-বিএনপির সমস্যা অর্থ নয়, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শক্তি। দেশের রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক শক্তি নাই বিএনপি-জামায়াতের। নিকট ভবিষ্যৎয়েও সরকার পতনের বড় কোন আন্দোলনে নামার বাস্তবতা নাই এই জোটের। মামলার বেড়াজালে বন্দী বিএনপির প্রথম সারির নেতা-কর্মীরা। আছে নেতৃত্বের সংকট। এও বলা হয় যে, নিজ নিজ ব্যবসায়ের স্বার্থে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞও থাকেন বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের অনেকে। খালেদা জিয়াও নানান কারণে দল ও দেশের অন্যান্যদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না।
এছাড়া, জামায়াতের অবস্থাও নাজুক। এ নিয়ে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ কার্যত ভেঙে পড়েছে। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ২৩ সদস্যের নির্বাহী পরিষদের আটজন জেলে, নয়জন আত্মগোপনে আছেন। তিনজন মারা গেছেন। একজন বিদেশে, একজন অসুস্থ, আরেকজন দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়।
এর বাইরে দলের চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল মহানগর কমিটির আমিরও জেলে আছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে মধ্যম ও নিচের সারির নেতারা হাল ধরেছেন কেন্দ্রীয় ও মহানগরের। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় জামায়াত-বিএনপিকে খলনায়ক করে বিডিনিউজ২৪ ডট কমের প্রকাশিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত।
ষড়যন্ত্রে তৃণমূল কংগ্রেস?
ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি বানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের হাস্যকর একটি সম্পর্কের কথাও বলা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, মমতা ব্যানার্জী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাদেশ নীতির বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সঙ্গে একাট্টা হয়ে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় নীতি থেকে একচুলও নড়েন না মমতা ব্যানার্জী। তাই, তিস্তাচুক্তি-স্থলসীমান্ত চুক্তি ইত্যাদি ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও মমতা ব্যানার্জী কাজ করেছেন একাট্টা হয়ে। বিডিনিউজ২৪ ডট কমের ‘হাসিনাকে উৎখাতে মার্কিন তৎপরতা’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিকে ‘পর্নোগ্রাফি অব কন্সপিরেসি’ বলে আখ্যা দেওয়াটাই স্বাভাবিক।