পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আর দলীয় সঙ্কটের মধ্যে বৈঠকের আহ্বান জানালেও স্ত্রী রওশনের ডাকে সাড়া দেননি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাকে ছাড়াই গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠক। তবে বিরোধী নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে সভায় উপস্থিত ছিলেন দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য। তারা রওশনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এরশাদের অনুপস্থিতি এবং এমপিদের বিভক্তি দলের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
জানা গেছে, পার্টির চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া তড়িঘড়ি করে সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে এই অজুহাতে গতকাল রওশনের সভায় উপস্থিত হননি এইচ এম এরশাদ। বৈঠকে অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রপতি সাংবাদিকদের বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আমার অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু বিষয়টি আগ থেকে আমাকে জানানো হয়নি, তাই আমি সভায় যাইনি।’
এরশাদের এমন বক্তব্যের জবাবে রওশন ঘনিষ্ঠ এক প্রেসিডিয়াম সদস্য দাবি করেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যানের অভিযোগ ঠিক নয়। নিয়ম মেনেই সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান নয়, নিয়ম অনুযায়ী বৈঠক আহ্বান করার এখতিয়ার রাখেন কেবল সংসদের বিরোধী নেতা। দল ভাঙতে যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাদের বুদ্ধি পরামর্শে পার্টির চেয়ারম্যান এ বৈঠকে অংশ নেননি।’ এজন্য দলের বর্তমান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ কয়েক নেতাকে দায়ী করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা দাবি করেন, ‘রওশনের বৈঠকটি ভণ্ডুল করতে শনিবার রাত থেকেই চেষ্টা চালিয়েছেন দলের মহাসচিব বাবলুসহ তার অনুগতরা। সংসদ সদস্যদের ফোন করে বৈঠকে না যেতে অনুরোধ জানানো হয়, কিন্তু তারপরও তার অনুরোধ উপেক্ষা করে রওশনের সভায় অংশ নেন দলের ২৮ জন সংসদ সদস্য।’
জানা গেছে, দুপুর ২টায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয় বিকাল সাড়ে তিনটায়। রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে তার সম্মেলন কক্ষে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে মসিউর রহমান রাঙ্গা ও তাজুল ইসলাম চৌধুরীর অব্যাহতি, পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধী নেতার দূরত্ব, গুটিকয়েক শীর্ষনেতার ষড়যন্ত্র-অপতত্পরতা, মন্ত্রিত্ব ছাড়ার বিষয়, বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট বিলসহ জাতীয় পার্টির কোন্দল নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় কথা বলেন সাবেক মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও মাইদুল ইসলাম মুকুল।
হাওলাদার বিরোধী নেতার উদ্দেশে বলেন, ‘গুটিকয়েক ষড়যন্ত্রকারী আপনার ও পার্টির চেয়ারম্যানের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত নেতাকর্মীরা যে কোন মূল্যে আপনাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য দেখতে চান।’ ফিরোজ রশীদ বিরোধী নেতাকে পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিলেমিশে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানান। একইকথা বলেন মুজিবুল হক চুন্নুও। তিনি সংসদে আসন্ন ইমপিচমেন্ট বিলের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। এছাড়া এ বিল নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন মাইদুল ইসলাম মুকুল।
বৈঠকে রাঙ্গা-তাজুল প্রসঙ্গ এবং আপাতত মন্ত্রিসভায় থাকার বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে। সংসদ সদস্যগণ বিরোধী নেতাকে পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে সব বিষয়ে সমাধানের অনুরোধ জানালে রওশন এরশাদ এসময় তাদের কথা দেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বিরোধী নেতা বলেন, ‘ পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার কোনো দূরত্ব নেই। আমরা সবসময় এক আছি। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাকে ভুল বুঝিয়ে দলে এবং আমাদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ষড়ন্ত্রকারীরা কোনোদিন সফল হবে না।
সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের জানান, ‘যাচাই-বাছাই করে বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট বিল নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা ও তাজুল ইসলাম চৌধুরীর অব্যাহতি প্রত্যাহারসহ দলের বর্তমান সঙ্কট নিরসনে বিরোধী নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভুল ত্রুটি থাকলে তাদের মার্জনা করে পার্টির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তাছাড়া দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া আপাতত মন্ত্রিসভায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ এসময় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিরোধী চিফহুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিরোধী নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ প্রমুখ।
দলটির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, পার্টির চেয়ারম্যানের অনুমতির অজুহাত দেখানো হলেও মূলত রওশনের ওপর অভিমান করে গতকাল দলের এ সংসদীয় সভায় যোগ দেননি এরশাদ। বৈঠক চলাকালে একেবারে শেষ পর্যায়ে সংসদে প্রবেশ করেন এরশাদ। এসময় তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ ৮ জন এমপি।