DMCA.com Protection Status
title="৭

দেশের নেতৃত্ব গ্রহণে তারেক রহমান সম্পূর্ণ প্রস্তুত : সিরাজুর রহমান

unnamed (33)লন্ডন থেকে সিরাজুর রহমানঃ প্রথমেই আমি বলবো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিবিসি থেকে আমরা তার বক্তৃতার রেকর্ড সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু আমি ফরাসি রেডিওর কাছ থেকে তার রেকর্ড সংগ্রহ করেছি। অবশ্য ওরা বিএনপির বিরুদ্ধে ওটা আর স্বীকার করবে না।
 
তারা বলেন, যে শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ বক্তৃতায় স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তা তিনি বলেছেন ঠিকই, কিন্তু পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যেন খুব শীঘ্রই জাতীয় সংসদের বৈঠক ডাকা হয় এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানমন্ত্রী করা হয় এবং তারও আগে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথাটা সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। আর আমরা এটা জানি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের জনক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কেননা, তিনি খুলে বলেছিলেন আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী নই। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী। অবশ্য তার আগেও এটা আমি বলবো যে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বিষয়টি কাজে শেখ মুজিবুর রহমানও দেখিয়েছেন।

 

আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, তাজউদ্দিন সাহেব ১৯৭১ সালে আশ্রিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তিতে কিছু কিছু কথা ছিল যে দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না। বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে ভারত এবং আরো বলা হয়েছিল বিডিআরকে ভেঙ্গে দিতে হবে এবং বিডিআরের পরিবর্তে বিএসএফ, ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড গঠন করা হবে।

 
কিন্তু তারপরে আপনারা দেখুন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে যখন বাংলাদেশে গেলেন তখন বাংলাদেশের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। আমার মনে আছে, সে বছরের এপ্রিল মাসেও ১৯৭২ সালে, আমি তখন স্বাধীন বাংলাদেশে যাই। আমি চাটগাঁ যাচ্ছিলাম সড়ক পথে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা হলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল ভরতের সঙ্গে। তিনি জানতে চাইলেন আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
 

যাই হোক, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ দফা চুক্তি মেনে নেননি। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করেন। এরপর তাকে ৭ দফা চুক্তিতে রাজি করানোর জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু মুজিব তাতে রাজি হয়নি। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি করেছিলেন, বিডিআর বাহিনী তিনি ভেঙে দেননি।

 
কাজেই আমি তাকে একজন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বলবো। তারপরও উনি যখন বাকশাল করলেন, কতিপয় সেনা কর্মকর্তা তাতে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করেছিল এবং তারপর যিনি রাষ্ট্রপতি হলেন, তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। শেখ মুজিবের এ হত্যায় ভারতীয়রা মনে মনে কিন্তু খুশিই হয়েছিল। কারণ, মুজিবুর রহমান যে একটা জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে ভারতের উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। তারা আশা করেছিল পরবর্তী যে আসবেন তিনি হয়তো ভারতের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হবেন। কিন্তু খন্দকার মোশতাক তা প্রত্যাখ্যান করেন। ভারত তাড়াতাড়ি তা বুঝে গিয়েছিল। কাজেই তার প্রতি তারা নাখোশ হয়েছিল।

এরপর দেখা গেল মোশতাকের বিরুদ্ধে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হলো যাতে খালেদ মোশাররফ নেতৃত্ব দেন। সেদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল। বিবিসিতে সংবাদ আমি প্রচার করেছিলাম এবং সেটাকে ব্যাপকভাবে মনে করা হতো ভারতের অনুকূলে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের অনুপ্রেরণায় সেটা সংগঠিত হয়েছিল।

 
কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জওয়ানরা, যারা মুক্তিবাহিনীর আদর্শ ধারণ করেছিল, তারা তাকে মেনে নিতে পারেনি। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে ছিলেন। খালেদ মোশাররফ পালিয়ে ভারত চলে যাবার সময় সিপাহিরা তাকে ধরে ফেলে এবং গুলি করে হত্যা করে। তারপর এই সিপাহিরাই গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত করে জিয়াউর রহমানকে সেনা সদর দফতরে ফিরিয়ে আনেন। এ হচ্ছে ব্যাপার।

এখন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি করে হতে পারে? বাঙালি সংস্কৃতি হতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ? বিমানবন্দরে আপনাকে যখন জাতীয়তা জিজ্ঞেস করে, তখন আপনি বলেন বাংলাদেশি অথবা ব্রিটিশ।

 
বাঙালি তো বলেন না। ভারতে আমার বহু বন্ধুবান্ধব আছেন। তারা নিজেদের বাঙালি বলেন না। তারা নিজেদের ইন্ডিয়ান বলেন। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে কোথা থেকে আসতে পারে? সে মোহটা ভঙ্গ করে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দর্শন মানেই জিয়াউর রহমান।

 

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমি প্রথমবার তার সাক্ষাৎকার নিতে যাই ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন কর্নেল অলি ছিলেন তার Personal secretary. তিনি টেপ রেকর্ডারটা কর্নেল ওলির হাতে দিয়ে বলেন, Oli, you have to look after Mr Rahman's tape recorder. Guard it with your life. It is as important to him as a Rifel to you and me. তারপর উনি বললেন, আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই। ভাববিনিময় করতে চাই। আমরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলাম, তার সার কথা হলো খুব সহজ। তিনি গোড়াতেই বাংলাদেশের সমস্যাগুলো নিয়ে বলেছিলেন।

 
 
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেনা সদস্যদের নিয়ে জাতীয় সেনা বাহিনী গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগের সদস্যরা এসে রক্ষীবাহিনী করলো। জাতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিকদের ইউনিফর্ম নাই, বুট নাই। কিন্তু সব আধুনিক সরঞ্জাম রক্ষীবাহিনীকে দেয়া হয়েছে। এই রক্ষীবাহিনী এবং জাতীয় সেনাবাহিনীতে টানাপড়েন ছিল। তারপর পাকিস্তানে যেসব বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা বদলি হয়েছিলেন, তারা এসে দেখলেন তাদের জুনিয়ররা তাদের সিনিয়র হয়ে গেছেন, সেখানেও একটা টানাপড়েন শুরু হলো।
 
কর্নেল তাহের তাদের মধ্যে একজন- যারা বলছিলেন বাংলাদেশে কোনো সেনাবাহিনী থাকার দরকার নেই। তাদের মধ্যে থেকে একটা ভলান্টিয়ার সেনাবাহিনী থাকবে। গণচীনের মতো। গণচীনে তখন ভলান্টিয়ার বাহিনী ছিল। এখন আর নেই।

 

জিয়া তখন বললেন, সেনাবাহিনীতে এসব নিয়ে বড় একটা সমস্যা আছে। সেনাবাহিনীতে 'Chain of command' পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তারপর তিনি বলেছিলেন, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ কে করেছে, কে করেনি তা নিয়ে সংশয়। কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, কেউ ছিল না। এখন যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, তারা তো তখন ভুল করেছিল। এখন তো তারা এখানে আছে। এদের যদি আমি জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত না করি, তবে এরা যাবে কোথায়? উনি আমাকে বললেন, আপনি তো বিলেতে থাকেন, আপনি কি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে বলে দেখবেন এদের নেবে কিনা? আর যখন কেউ নেবে না তখন আমি কি করবো? আমি কি তখন এদের সকলকে বঙ্গপোসাগরে ফেলে দিয়ে আসবো?

 
তা যদি না পারি, তাহলে প্রতিমুহূর্তে আমাকে আমার পিঠ পাহারা দিতে হবে। পিঠে কে কখন ছুরি বসায়। তার চেয়ে ভালো জিনিস আমরা তাদের জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত করি। আমরা সকলে মিলেমিশে এক জাতি হয়ে যাই। এদেশে বহু সমস্যা, সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবো।

 

তারপর উনি আমাকে বলেছিলেন, আমি জানি বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। আমরা জানি, শেখ মুজিবুর রহমান পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে ভুল করেছে। আমি খুব শীঘ্রই পত্রিকাগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাই। বাকশাল করে সবগুলো রাজনৈতিক দলকে বেআইনি করে দেয়া হয়েছিল। আমি সবগুলো রাজনৈতিক দলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র যথাসত্বর চালু করার জন্য আমি বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছি।

 
তিনি আরেকটি বড় সমস্যার কথা বললেন শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে। দেশ ছোট, জনসংখ্যা বিরাট। শিক্ষিতরা লেখাপড়া শেষ করে আশা করেছিল তারা ভালো চাকরি পাবে। কিন্তু এখন যে অবস্থা আছে, আমি তাদের চাকরি দিতে পারছি না। এদের যদি আমি জাতীয় জীবনে এবং গঠনমূলক কাজে না লাগাতে পারি, তবে এরা বিদ্রোহ করবে। দেশ রক্ষার্থে আপাতত এগুলোই প্রধান কাজ।

 

জিয়াউর রহমানের অর্জন আপনারা সবাই জানেন। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ বইটিতে জিয়াউর রহমান ছাড়াও তারেক রহমানের কথা আছে। তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী দর্শন পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সম্পর্কে আমি ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ভালোভাবে জানা শুরু করি। যখন তিনি তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাজ করেছিলেন। তিনি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে আবার জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। তারপরে উনার হাওয়া ভবন নিয়ে উনি কাজ করেছেন।

রাজনীতি নিয়ে কাজ করলে শুধু হবে না, রাজনীতি নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক এবং তৃণমূলকে নিয়ে যে রাজনীতি করা হয়, তারেক রহমান সে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আমরা তার সুফল দেখেছি। তার সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে তখন আমি বেশি করে অবগত হয়েছি।

 
এখন, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন আমরা পড়ছি ও উদ্বিগ্ন হচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে এ সমস্যা মোকাবেলা করতে তারেক রহমান প্রস্তুত কিনা। আমি মনে করি দেশের নেতৃত্ব ভার গ্রহণে তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সবশেষে আখতার মাহমুদের এ সময়োপযোগী ও তথ্যসমৃদ্ধ সহজপাঠ্য বইটি প্রশংসার দাবি রাখে।

 

লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও তারেক রহমান’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলাম লেখক সিরাজুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণ।

 
 

 

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!