দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ নানামুখী টানাপড়েনে ঝুলে গেছে ছাত্রদলের নতুন কমিটির ঘোষণা। সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরও কমিটি চূড়ান্ত করতে পারেননি শীর্ষ নেতৃত্ব। ছাত্রদল পুনর্গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মতদ্বৈততার কারণে শুরু হয়েছে এ টানাপড়েন ।
ফলে বাড়ছে গ্রুপিং-কোন্দল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি ও অপপ্রচার। তিন দিন ধরে টানা বিক্ষোভ চলছে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সামনে। ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, খালেদা জিয়ার নির্দেশনা মেনে কমিটি গঠিত হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
তারা জানান, পুনর্গঠন ইস্যুতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তিন দফায় মতবিনিময় করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি ছাত্রনেতাদের বক্তব্য, প্রস্তাবনা, পরামর্শ শুনেছেন।
শেষে তার বক্তব্যে নতুন কমিটির কিছু দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, দাদা-চাচা মার্কা কোন কমিটি দিতে চান না। অবিবাহিত, সাহসী, নির্যাতিত ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ছাত্রত্বধারীদের নিয়েই হবে নতুন কমিটি।
তার এ বক্তব্যের পর প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় সংগঠনের সকল পর্যায়ে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা কমিটি পুনর্গঠনে জড়িয়ে পড়েন অনৈক্যে। প্রথমে নানা যুক্তি দেখানো হয় বয়স্ক ছাত্রনেতাদের পক্ষে। সম্ভাব্য তরুণ নেতাদের বিরুদ্ধে চালানো হয় অপপ্রচার।
দেশে-বিদেশে চলছে লবিং-তদবির। কিন্তু সংগঠনের ভেতরে-বাইরে নানামুখী চাপের কারণে পরে তরুণদের পক্ষে অবস্থান নেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তারপর শুরু হয় আরেক খেলা। সংশ্লিষ্টরা তাদের পছন্দের ছাত্রনেতাদের নিয়ে কমিটি গঠনের তৎপরতা শুরু করেন। ইতিমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজনকে চীন সফরে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সদস্য করা হয়।
এরপর তিনি বিদেশ যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে কমিটি ঘোষণার উদ্যোগ নেন। সুপার ফাইভ কমিটি তৈরি করে সম্ভাব্য তিন ছাত্রনেতাকে খালেদা জিয়ার বাড়িতে ডেকে নেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে প্রণীত সে কমিটির সম্ভাব্য নেতাদের বিষয়ে কিছু তথ্য খালেদা জিয়ার নজরে আনেন বিএনপির কয়েকজন নেতা। ফলে সে কমিটি অনুমোদন দেননি তিনি।
সূত্র জানায়, পুনর্গঠিত কমিটিতে সভাপতি হিসেবে চূড়ান্ত করা হয় বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহসানকে। আকরামুল হাসান ও মামুনুর রশীদ মামুনের মধ্যে একজন সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যজনকে সিনিয়র সহ-সভাপতি চূড়ান্ত করা হয়।
এছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে রাখা হয় আসাদুজ্জামান আসাদ, মিয়া মোহাম্মদ রাসেল ও আবদুল ওয়াহাবের নাম।
সূত্র জানায়, বিএনপি ও অঙ্গদলের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি একাধিক পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা ছাত্রদলের সম্ভাব্য নেতাদের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার কাছে নানা তথ্য পেশ করেছেন। সভাপতি হিসেবে যাকে চূড়ান্ত করা হয়েছে তিনি আওয়ামী পরিবারের সন্তান।
সবচেয়ে বড় কথা তার জন্য লবিং-তদবির করেছেন জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তার বাসায় একটি বৈঠকও হয়েছে। ছাত্রনেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতা নির্বাচনে কিভাবে জোটের শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা লবিং-তদবির করেন?
এছাড়া সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে আলোচিত দুই নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। একজনের বিরুদ্ধে জুয়েল-হাবিবের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে প্রভাব সৃষ্টি এবং অন্যজনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করলেও আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তাদের বিবেচনা করা হয় ছাত্রদল পুনর্গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দের অনুসারী হিসেবে। যদিও তারুণ্যনির্ভর কমিটি গঠনে তাদের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার কথাও আলোচনায় আছে।
ছাত্রনেতারা জানান, যোগ্যতা যা-ই থাকুক, অতীতেও দায়িত্বপ্রাপ্তদের পছন্দের অনুসারীরাই পেয়েছেন বড় বড় পদ। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সম্মানজনক পদ পাননি অনেকেই। ছাত্রদল কর্মীরা জানান, সাংগঠনিক ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে যে তিনজনের নাম প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে তারা তিনজনই বিবাহিত।
এর মধ্যে রাসেলের স্ত্রী দুদকে চাকরি করেন। ওয়াহাব বিয়ে করেছেন মামাতো বোনকে। আসাদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং টেন্ডারবাজির এক মামলায় কিছুদিন কারাভোগও করেছেন।
কিন্তু ছাত্রদল পুনর্গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পছন্দের কারণেই বিবাহিত ও বিতর্কিত হওয়ার পরও প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে তাদের নাম। গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নামে-বেনামে একাউন্ট থেকে এসব তথ্য তুলে ধরছেন ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
তারা বলছেন, ছাত্রদলের সঙ্গে মতবিনিময়ে খালেদা জিয়ার পরিষ্কার নির্দেশনার পরও কমিটি গঠনে গড়িমসি করা হচ্ছে। এদিকে নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে- এমন সংবাদে মঙ্গলবার ও বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ভিড় করে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শ’ ছাত্রদল কর্মী চারপাশে অবস্থান নেয়। বুধবার দুপুরেও ছাত্রদলের একটি অংশ দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশে অবস্থান নেয়। সূত্র জানায়, আন্দোলনের সময় রাজপথে নিষ্ক্রিয়, গ্রুপিং নির্ভর এবং আঞ্চলিক প্রভাবে কাউকে নেতৃত্ব দেয়া হলে সংঘর্ষ ঘটতে পারে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্রোহের মুখে পড়বে সে কমিটি। ফলে অতীতের ধারাবাহিকতায় নতুন কমিটির ভাগ্যেও নেমে আসবে ব্যর্থতা।
সূত্র জানায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কমিটি ঘোষণায় কিছুটা সময় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেই চূড়ান্ত করা হতে পারে কমিটি।