আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিয়ে ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত ক্রিমিয়া অঞ্চল থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
শনিবার রুশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে ইউক্রেনে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর প্রস্তাব পাস হওয়ার পর পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা এ অনুরোধ জানান বলে বিবিসি জানিয়েছে।
দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার ওই টেলিফোন আলাপের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পুতিনের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্রিমিয়ায় রুশ সেনা পাঠানোর ঘটনাকে ইউক্রেনের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি ক্রিমিয়া থেকে শিগগির সেনা সদস্যদের রুশ ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে পুতিনের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি রুশ প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাশিয়া যদি সেনা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে সেটি হবে জাতিসংঘ সনদ এবং ইউক্রেনের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির চূড়ান্ত লঙ্ঘন। তিনি আরো বলেন, কৃষ্ণসাগর এলাকায় মস্কোর ভূমিকার কারণে রাশিয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে।
কিন্তু পুতিন ওবামার সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে বলেন, ইউক্রেনের রুশভাষী জনগোষ্ঠীর জীবন এখন হুমকীর মুখে। এ অবস্থায় পূর্ব ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ায় যদি সহিংসতা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে নিজ দেশের স্বার্থ এবং রুশ ভাষাভাষিদের রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার রাশিয়ার আছে।
ইউক্রেনের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট অলেকসান্দোর তুর্কিনভ বলেছেন, রাশিয়ার পার্লামেন্টে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাব অনুমোদনের পর দেশটির সামরিক বাহিনীকে পুরো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তবে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী আর্সেনি ইয়াৎসেনুক বলেছেন, তার সরকার মনে করে মস্কো সামরিক হামলা চালাবে না।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গেও কথা বলার পর তিনি জানিয়েছেন সেনা পাঠানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর আগে ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এক অনুরোধ অনুমোদন করেছে রুশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে, এর অর্থ এই নয় যে ইউক্রেনে রুশ সেনা মোতায়েন আসন্ন।
ক্রিমিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে ওই অঞ্চলের নতুন প্রধানমন্ত্রী সের্গেই আকসিওনভের সাহায্যের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুমোদন চান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়ার সংসদের উচ্চকক্ষের অনুমোদনের পর ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ইউক্রেনে রুশ সেনা হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই দেশটির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধানের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকের পর সেদেশের সেনাবাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রেখেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট তুর্কিনভ।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি যুদ্ধ-সতর্কতা জারি করে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখার কথা বলেছেন তিনি। এছাড়া পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ দেশটিতে কৌশলগত ও অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন, দেশটিতে অগত্যা যদি সেনা আক্রমণ ঘটেই যায়, সেটি সামাল দেয়ার জন্যও আগে-ভাগেই একটি কর্মপন্থাও ঠিক করে রেখেছে দেশটির নিরাপত্তা পরিষদ।
পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছে দেশটির নতুন সরকার। ক্রিমিয়ায় রুশ ‘আগ্রাসন’ ঠেকাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ইউরি সের্গেয়েভ। শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। আমরা মনে করি, একটি সংঘাত ঠেকানোর এখনও সময় আছে।’
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন উভয়পক্ষের প্রতি ধৈর্য্যধারণ এবং প্রত্যক্ষ সংলাপ বিনিময়ের আহ্বান জানিয়েছেন। জরুরিভিত্তিতে ক্রিমিয়ার পরিস্থিতি শান্ত রাখার দাবি জানিয়েছেন ন্যাটো প্রধান এন্ডার্স ফগ রাসমুসেন। এছাড়া ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন আহ্বান করেছে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শনিবার রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরবর্তী পদক্ষেপে সমন্বয়ের বিষয়ে তিনি শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও কথা বলেন।
ক্রিমিয়ায় রুশ আগ্রাসন
ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত ক্রিমিয়া অঞ্চলটি রুশ সেনারা দখল করে নিয়েছে। সেখানকার একাধিক প্রশাসনিক ভবন এবং সামরিক ঘাঁটিগুলো তারা পাহারা দিচ্ছে। এছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানকার পার্লামেন্ট ভবন, বিমানবন্দরগুলো, সরকারি টেলিভিশন ভবন এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।
রাশিয়া ক্রিমিয়ায় আরো ৬ হাজার সেনা এবং ৩০টি অতিরিক্ত সাঁজোয়া যান মোতায়েন করেছে বলে শনিবার সকালে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আইহর তেনিউখ জানিয়েছেন।
ক্রিমিয়ার মস্কোপন্থি প্রধানমন্ত্রী সের্গেই আকসিওনভ কিয়েভের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি রুশ প্রেসিডেন্টের প্রতি ওই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করারও অনুরোধ জানিয়েছেন।
শুধু ক্রিমিয়া নয়, ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার বিভিন্ন শহরে জাতিগত রুশরা ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পক্ষে দোনেৎস্ক শহরে ৭ হাজার লোক মিছিল বের করে এবং তারা আঞ্চলিক প্রশাসনিক ভবনটিও দখলে নেয়া চেষ্টা করে। এছাড়া ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রুশপন্থি এবং রুশ বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মারিউপোল শহরে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সিটি কাউন্সিল ভবনের বাইরে রুশ পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, গত নভেম্বরে ইউরোপের সঙ্গে একটি চুক্তি বাতিল করার প্রতিবাদে দেশটিতে যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তারই ধারাবাহিকতায় পতন ঘটে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সঙ্কট বাড়ছে। এই সঙ্কটকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ যুগের উত্তেজনা আবারো ফিরে আসছে বলেও মনে করা হচ্ছে।