চট্টগ্রাম: বন্দর নগরী চট্টগ্রামে কয়েক বছর ধরেই চলছে বিলবোর্ড আগ্রাসন। আর প্রতিবছর ঈদ-পূজার সময়টাতে এ আগ্রাসন বেড়ে যায় যাচ্ছেতাইভাবে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে যায় রাজনীতিবিদদের শুভেচ্ছা বার্তায়। তবে এবার সেই রাজনীতিকদের হটিয়ে ব্যানার ফেস্টুন আর বিলবোর্ডের মাধ্যমে ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়ে নগরজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন নবনিযুক্ত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার আব্দুল জলিল মণ্ডল। পুলিশ কমিশনারের শুভেচ্ছা সম্বলিত বেশিরভাগ বিলবোর্ডই সিটি করপোরেশনের অনুমোদনবিহীন হওয়ায় সমালোচনার পালে জোর হাওয়া লেগেছে।
ঈদ ও পূজা উপলক্ষে পুলিশ কমিশনার নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কদ্বীপ (আইল্যান্ড), ফুট ওভার ব্রিজ, রাস্তার মোড়ে বিলবোর্ডের মাধ্যমে নগরবাসীকে পূজা ও ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার এমন ‘শুভেচ্ছা’ জানানোর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ।
তাদের প্রশ্ন, চট্টগ্রামে বিলবোর্ড আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেখানে নাগরিক সমাজ সোচ্চার, সেখানে নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়ে তিনি কী করে এই বিলবোর্ড আগ্রাসনে নাম লেখান? নানা উচ্চ বিলাসের কারণে নগরের সৌন্দর্য হানি করে যত্রতত্র বিলবোর্ড ও ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান রাজনীতিকরা। তবে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে পুলিশ কমিশনার কেন এরকম শুভেচ্ছা জানাতে গেলেন?
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়ুদল কাদের চট্টগ্রামের এই বিলবোর্ড আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বিলবোর্ডে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক রূপ দেখা যায় না। পাহাড়, সমুদ্র আর গাছ সবই ঢাকা পড়ছে এই বিলবোর্ডের নিচে। প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রামে এখন আর সবুজ দেখা যায় না।’
এসব বিলবোর্ড উচ্ছেদে ব্যর্থ হওয়ায় সিটি মেয়রেরও তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মন্ত্রী।
চট্টগ্রামে বিলবোর্ড আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘সদ্যনিযুক্ত পুলিশ কমিশনারের হঠাৎ এই ধরণের শুভেচ্ছাপ্রীতি দেখে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ রীতিমত হতবাক। একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে কেন তাকে বিলবোর্ডের মাধ্যমে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানাতে হবে? তার সুনাম কিংবা বদনাম নির্ভর করবে তার পুরো বাহিনীর কর্মকাণ্ডের উপর।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ কয়েক বছর ধরে যেখানে বিলাবোর্ড আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার সেখানে তিনি কীভাবে এসব অবৈধ বিলবোর্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে গেলেন? একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে যেখানে এসব অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদে পুলিশ সিটি করপোরেশনকে সহযোগীতা করার কথা সেখানে তিনিই এসব কাজ করেছেন।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের প্রধান পরিদর্শক আবুল মনসুর বলেন, ‘নগরজুড়ে এমন অবৈধ বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি। তারমধ্যে পুলিশ কমিশনারের শুভেচ্ছা বিলবোর্ডে ভরে গেছে। এর বেশিরভাগই অবৈধ বিলবোর্ডে লাগানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে কয়েক দিন আগে বিলবোর্ডে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য অনুমতি নিতে আসা হলেও আমরা অনুমতি দেইনি। এরপরও কয়েক জায়াগায় আমরা বাধা দিয়েছি। হয়তো নগরের বিভিন্ন স্থানে কোনো কোম্পানি কমিশনারের হয়ে এসব অবৈধ বিলবোর্ড, ফেস্টুন লাগিয়েছে।’
‘এখন উনি নগরের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে অবৈধভাবে বিলবোর্ডে শুভেচ্ছা জানালে অন্যদের তখন আমরা কি বলবো?’ প্রশ্ন রাখেন সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, প্রবর্ত্তক, চকবাজার, অক্সিজেন, জিইসি মোড়, একেখান মোড়, অলংকার মোড়, বড়পোল, বন্দর, আগ্রাবাদ, নিউমার্কেট, লাভলেইন, কাজীর দেউড়ি, ওয়াসা মোড়, গোলপাহাড় মোড়, টাইগারপাস মোড়, রাহাত্তারপুল, নতুন ব্রিজ এলাকা, চাক্তাই, দেওয়ান হাটসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে প্রায় দেড় শতাধিক বিলবোর্ড ও ফেস্টুনে ঈদুল আজহা ও শারদীয় দুর্গা পূজার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। এসব শুভেচ্ছা ব্যানারের অনেকগুলো আবার সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত বিলবোর্ডের ওপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনের ওপর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিলবোর্ড ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম অ্যাডভ্যার্টাইজিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘নগরের বিভিন্ন বিলবোর্ডে পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যানার ফেস্টুন লাগানোর কথা শুনেছি। বেশ কয়েকটি স্থানে আমি দেখেছিও। তবে তাদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। হয়তো রাতের আঁধারে তারা এসব করেছে। এখন কী আর করবো। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অল্প সময়ের জন্য এভাবে তাদের ব্যানার আমাদের বিলবোর্ডে লাগিয়ে থাকে। তখন করার কী আছে।’
এমনকি কয়েকটি সংবাদপত্রের বিলবোর্ডও বিনা খরচে লাগিয়ে থাকে বলে দাবি করেন ফরিদ মাহমুদ।
সিএমপির একজন পুলিশ পরিদর্শক জানিয়েছেন, ‘সিএমপির নিজস্ব তহবিল থেকে বিলবোর্ডের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।’ তবে আরেকটি সূত্র বলছে, ‘একটি পক্ষ পুলিশ কমিশনারকে খুশি করতে তাদের খরচেই এসব বিলবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে।’
এদিকে পুলিশ কমিশনারের এই শুভেচ্ছাপ্রীতি নিয়ে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজে রীতিমত ঝড় উঠেছে। যার প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। এনিয়ে সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চাকরিজীবীরা পুলিশ কমিশনারে প্রতি নেতিবাচক বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। আবুল হাসনাত নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মন্তব্য ছিল- ‘এবার তার (পুলিশ কমিশনার) কাছে রাজনীতিবিদরা ফেল করেছেন।’ এছাড়াও নানা জনের নানা মন্তব্য রয়েছে এই বিলবোর্ড শুভেচ্ছা নিয়ে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে সিএমপির পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মণ্ডল বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে নতুন যোগদান করেছি। তাই নগরবাসীকে ঈদ ও পূজা উপলক্ষে শুধুমাত্র শুভেচ্ছা জানিয়েছি। এখানে আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধুমাত্র সৌজন্যতা আর পরিচিতি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বৈধ আর অবৈধ না, এগুলো শুধুমাত্র তিন-চার দিনের জন্য অস্থায়ীভাবে লাগানো হয়েছে। পূজা শেষ হয়ে এখন ঈদের পর সব বিলবোর্ড আর ফেস্টুন সরিয়ে ফেলা হবে।’