নির্বাচন বর্জন করে কোনো দল দেশকে জিম্মি করে রাখতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকায় ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনারের বাসায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন,
বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতেই ভারত ওই নির্বাচনকে সমর্থন করেছে। অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল, সবাই নির্বাচনে আসবে। যারা আসেনি তাদেরই ক্ষতি হয়েছে।
বীণা সিক্রি বলেন, 'আমি মনে করি না, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর বাংলাদেশের জনগণ আবার সাংবিধানিক সংকট দেখতে চায়। নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং তাতে সবার অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া কোনো দলের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু আমি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না এবং এ কারণে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না- এমন অবস্থান নিয়ে কোনো দল দেশকে জিম্মি করতে পারে না।'৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাবি্লউ মজিনার নয়াদিলি্ল সফর এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মতপার্থক্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বীণা সিক্রি বলেন, 'বিষয়টিকে আমি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য হিসেবে দেখতে চাই না। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের ইস্যু। আমি ওই নির্বাচনকে সমর্থন করি। কারণ নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতে পারত।'
অংশগ্রহণমূলক না হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনকে সমর্থন করার যুক্তি তুলে ধরে বীণা সিক্রি বলেন, নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম ও অপরিহার্য অংশ হলেও তা যথেষ্ট নয়। নির্বাচন এককভাবে গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে পারে না। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন। সব মিলেই গণতন্ত্র।
বীণা সিক্রি বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কী অবস্থান তা ওই দেশের রাষ্ট্রদূতের বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট। তবে ভারত মনে করেছিল, নির্বাচন হওয়া উচিত এবং তাতে সবারই অংশ নেওয়া উচিত।
ভারতের সমর্থনেই বর্তমান সরকার টিকে আছে- নির্বাচন বর্জনকারীদের এমন সমালোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বীণা সিক্রি বলেন, 'যারা এটি বলে, তাদের আমি বলব বিশ্বের দিকে তাকাতে। তারা দেখুক, আজ পর্যন্ত কয়টি দেশ নির্বাচনকে সমর্থন করেছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে অনেক বিশ্ব নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন গত কয়েক মাসে। তাঁরা কেউ তো বলেননি যে আপনাদের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, আপনাকে আমরা মানি না। এর অর্থ তাঁরা আপনার (এ সরকার) সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন।'
বীণা সিক্রি বলেন, 'এটা সত্য যে, গণতন্ত্রে সংলাপ থাকতে হবে। রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যমসহ সমাজের সব শাখার সঙ্গেই নিয়মিত সংলাপ হতে হবে। আমার মনে হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ভারতের যে অবস্থান ছিল তা নির্বাচনের ১০ মাস পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও গ্রহণ করেছে। এটির প্রমাণও দৃশ্যমান।'
একজন প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতের নির্বাচনের আগে ও পরের বক্তব্যের সমালোচনা করে বীণা সিক্রি বলেন, 'আপনারা এখানে বন্ধু হিসেবে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসেন। কিন্তু আপনাদের কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা থাকতে পারে না। ভারত বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা রাখেনি। ভারত মনে করেছে, বাংলাদেশে যথাসময়ে নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বাংলাদেশেরই। নির্বাচনকে সমর্থন করে ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই সমর্থন করেছে।'
ভারতে মনমোহন সিংয়ের সরকারের বিদায়ের পর মোদি সরকারও এই নীতি অব্যাহত রাখবে কি না জানতে চাইলে বীণা সিক্রি বলেন, 'ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন তাঁর সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে হয়। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের আমলে যখন আমি বাংলাদেশে হাইকমিশনার তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক ভালো বৈঠক হয়েছে। ২০০৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে ইউপিএ সরকার। তখন ঢাকার পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল, আমাকে ফেরত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি ঢাকায় আমার মেয়াদ পূর্ণ করেছি। বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সব সময় একই থাকে। এটি সব দলের ও রাষ্ট্রের নীতি বলেই ধরা হয়।'
নির্বাচন প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের জনগণের বড় অংশকে অগ্রাহ্য করেছে- বিএনপি নেতাদের এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বীণা সিক্রি বলেন, 'আমি আবারও বলব, আপনারা যদি নির্বাচনের সংজ্ঞা দেখেন তবে তা হলো এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে জনগণ তাদের পছন্দ প্রকাশের সুযোগ পায়। তাই গণতন্ত্রে নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
বীণা সিক্রি বলেন, সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত। এতে বাংলাদেশিরাই খুশি হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ইস্যুগুলো প্রায় অভিন্ন উল্লেখ করে বীণা সিক্রি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে থেকে কেউ এসে এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে পারে না। এটি হতে দেওয়াও ঠিক নয়।
হাইকমিশনার হিসেবে বীণা সিক্রি তাঁর মেয়াদে (২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের নভেম্বর মাস) বাংলাদেশের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওই সময়কে তিনি কঠিন ও জটিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের ওই সময়ে এ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনার কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েনের সক্রিয় সাক্ষী তিনি।
এমনকি এক অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান নিজের বক্তৃতার কপি ছিঁড়ে ফেলে রীতিমতো ভারতবিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন। সে সময় সেখানে উপস্থিত পাকিস্তানের হাইকমিশনার অনুষ্ঠান শেষে বীণা সিক্রিকে বলেছিলেন, তিনি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ বীণা সিক্রি সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। উপরন্তু অনুষ্ঠান শেষে মোরশেদ খানের সঙ্গে করমর্দনও করেছিলেন। কিন্তু এর কয়েক দিন পরই পাকিস্তানের সেই হাইকমিশনারকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। জনশ্রুতি আছে যে, তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের কাছে অভিযোগ করেছিল ঢাকা।
বীণা সিক্রি আরো বলেন, 'খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতেও ভারত অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ভারতের সচিব, মন্ত্রীদের ঢাকা সফরের আগে হুমকি দেওয়া হতো।'
বীণা সিক্রি বলেন, "বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) কার্যক্রম শুরু হলেও তাদের উত্থান হয় ৯/১১-এর পর। সে সময় খালেদা জিয়ার জোট সরকারও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। ৯/১১-এর পর আফগানিস্তানে অভিযান শুরুর পর জেএমবি সদস্যরা দেশে ফিরে আসে। আজ ইরাক, সিরিয়ায় আইএস (ইসলামিক স্টেট) যেভাবে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে, সেভাবে বাংলাদেশেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল জেএমবি। রাস্তায় প্রকাশ্যে শোডাউন করেছে। এসব বিষয় গণমাধ্যমে আসলেও খালেদা জিয়ার সরকার তা অস্বীকার করে বলেছিল, সবই নাকি গণমাধ্যমের অপপ্রচার। জামায়াতদলীয় শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী সে সময় গণমাধ্যমের খবরগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক বিবৃতি দিয়েছিলেন। জেএমবির অনেক সদস্যই অতীতে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।"
বীণা সিক্রি বলেন, 'ভারতের পক্ষ থেকে এসব বিষয় খালেদা জিয়ার সরকারের কাছে তোলার পরও তা যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমি হাইকমিশনার থাকার সময় চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে। আমরা জানতে পারি, সেগুলো ছিল পরেশ বড়ুয়ার। সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার পর বিএনপি সরকার জঙ্গিবাদের কথা কিছুটা স্বীকার করতে শুরু করে।'
এসব বিষয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের পার্থক্য কী জানতে চাইলে বীণা সিক্রি বলেন, 'খালেদা জিয়ার সরকারের সময় ভারতের প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল নিরাপত্তা পরিস্থিতি। আজ যে সমস্যা বাংলাদেশের, আগামীকাল তা ভারতকে মোকাবিলা করতে হবে। এর প্রমাণ গত ২ অক্টোবরের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনা।'
বীণা সিক্রি বলেন, খালেদা জিয়ার সরকারের সময় দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা, পাকিস্তানি জঙ্গিদের তৎপরতা, ভারতের জাল ব্যাংক নোট তৈরি ছিল নয়াদিলি্লর জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে এগুলো কঠোরভাবে দমন করে। এটি ভারতের কাছে দৃশ্যমান। দুই দেশ এখন নিরাপত্তা বিষয়ে তথ্যবিনিময় করে। একে অন্যের উদ্বেগের বিষয়ে সাড়া দেয়। আগে এমনটি ছিল না।
বীণা সিক্রি বলেন, ভারতে শক্তিশালী সরকার এসেছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে মোদি সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। কারণ তাঁর অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভারতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হতে হলে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর উন্নয়ন দরকার।
বীণা সিক্রি মনে করেন, মোদি সরকার যত দ্রুত সম্ভব স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করবে। গঙ্গা চুক্তির সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দুই দেশের কাছে ৪০ বছরের তথ্য-উপাত্ত ছিল। তিস্তা চুক্তির জন্য তা নেই। এর পরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সব নদ-নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় চমৎকার কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।