বর্তমান জাতীয় সংসদের ১৬ জন স্বতন্ত্র সাংসদের মধ্যে ১০ জনই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কোনো না পদে বহাল রয়েছেন।
অথচ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৬ (ঠ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নির্বাচনে কেহ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হইলে দল হইতে সরাসরি বহিষ্কার হইবেন এবং যাহারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করিবেন, তাহারা তদন্ত সাপেক্ষে মূল দল বা সহযোগী সংগঠন হইতে বহিষ্কার হইবেন।’ এই ধারা ওই ১০ জনের জন্য কার্যকর হয়নি।
স্বতন্ত্র সাংসদদের দলীয় পদে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটা তো অসম্ভব সংসদ, এখানে সব সম্ভব। এ জন্যই তো সংসদে স্বতন্ত্র সাংসদেরা কোনো জোরালো ভূমিকা রাখেন না। এখন তাঁদের পরিষ্কার করতে হবে তাঁরা দলীয়, না নির্দলীয়।’ এই ১০ স্বতন্ত্র সাংসদ হলেন হাজি মো. সেলিম (ঢাকা-৭), রহিম উল্লাহ (ফেনী-৩), মো. আবুল কালাম আজাদ (গাইবান্ধা-৪), মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার (নওগাঁ-৩), মকবুল হোসেন (মেহেরপুর-২), মো. রেজাউল হক চৌধুরী (কুষ্টিয়া-১), তাহজীব আলম সিদ্দিকী (ঝিনাইদহ-২), স্বপন ভট্টাচার্য্য (যশোর-৫), সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (নরসিংদী-৩) ও ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (কুমিল্লা-৩)।
জানা গেছে, ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি মো. সেলিম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রায় সব কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয়। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। অথচ সংসদে তিনি স্বতন্ত্র জোটের প্রধান।
গাইবান্ধা-৪ আসনের সাংসদ মো. আবুল কালাম আজাদ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাবেক এই চেয়ারম্যান বর্তমানে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় রয়েছেন। নওগাঁ-৩ আসনের সাংসদ মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। নির্বাচনের সময় দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলে রাব্বি তাঁকে পুনরায় ওই পদে ফিরিয়ে এনেছেন।
মেহেরপুর-২ আসনের সাংসদ মকবুল হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। জেলায় দলীয় প্রায় সব কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয়। গত ১৬ নভেম্বর ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ মো. রেজাউল হক চৌধুরী দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। গত ২৫ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।
ঝিনাইদহ-২ আসনের সাংসদ তাহজীব আলম সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশকে নিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। যশোর-৫ আসনের সাংসদ স্বপন ভট্টাচার্য্য বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নির্বাচনের সময় জেলা আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করলেও পরে তা কার্যকর করা হয়নি। তবে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ডে তেমন সক্রিয় নন বলে জানা গেছে।
নরসিংদী-৩ আসনের সিরাজুল ইসলাম মোল্লা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। নির্বাচনের সময় তিনি সংগঠন থেকে পদত্যাগপত্রও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নির্বাচিত হলে সেটা আর কার্যকর করেনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে সেখানে বক্তব্য দেন। কুমিল্লা-৩ আসনের সাংসদ ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তাঁর নেতৃত্বেই সেখানে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। দলীয় সব কর্মসূচিতে তিনি রয়েছেন সক্রিয়।
ফেনী-৩ আসনের সাংসদ রহিম উল্লাহ জেদ্দা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি দাবি করেন, ওই কমিটি আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সমমর্যাদার। দলের পদে আছেন আবার সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে রয়েছেন, কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেন, জানতে চাইলে রহিম উল্লাহ বলেন, ‘সংসদে আমাদের স্পিকার স্বতন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন না। তিনি বলেন ফেনী-৩ আসনের সাংসদ রহিম উল্লাহ। আর দলে থাকা না-থাকা নির্ধারণ করবেন প্রধানমন্ত্রী।’ উল্লেখ্য রহিম উল্লাহকে সংসদের ওয়েবসাইটের সাংসদদের তালিকায় আওয়ামী লীগ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাকি ছয়জন স্বতন্ত্র সাংসদের মধ্যে পিরোজপুর-৩ আসনের রুস্তম আলী ফারাজী, নরসিংদী-২ আসনের কামরুল আশরাফ খান এবং পার্বত্য রাঙামাটির উষাতন তালুকদার আওয়ামী লীগের রাজনীতি সঙ্গে জড়িত নন। বাকি তিনজন আওয়ামী লীগের পদে না থাকলেও তাঁদের সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় দলটির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। অংশ নিচ্ছেন দলীয় নানা কর্মসূচিতেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বতন্ত্র জোটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বিধি-বিধান মেনেই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। সংসদ আলাদা, পার্টি আলাদা। আমরা স্বতন্ত্র সাংসদ যারা আছি, তারা সাদাকে সাদা বলি, কালোকে কালো বলি। কোনো দলের হয়ে কথা বলি না।’
স্বতন্ত্র সাংসদের বেলায় আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের এ ধারা কার্যকর না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘তারা তাদের মতো কাজ করছে। এতে তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’ এ ছাড়া আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম ও দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। তাঁরা এ বিষয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।