DMCA.com Protection Status
title="৭

এরশাদ : নিজ ঘরে পরবাসী

1393867241.জাতীয় পার্টিকে প্রকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তুলতে না পারায় ঘরে বাইরে সংকটে পড়ে গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ। উপজেলা নির্বাচনে ভরাডুবি, সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ, মাথার ওপর মঞ্জুর হত্যা এবং রাডার ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা, দলীয় এমপিরা তাঁর কথা না শোনায় প্রচ- চাপে পড়ে গেছেন তিনি। দলের বঞ্চিত নেতাকর্মীদের অভিযোগ ইচ্ছামতো দল পরিচালনা করা, নেতাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন না করে খেয়ালখুশি মতো পদ-পদবি দেয়া, বহিষ্কার করা এবং ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোয় রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করায় এখন চরম সংকটময় সময় অতিক্রম করছেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। তার নির্দেশে;বাঘে-মহিষে; এক ঘাটে পানি খেতেন অথচ এখন তার কথা অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই কর্ণপাত করেন না। কর্পোরেট হাউজের মতো গড়ে ওঠায় জাতীয় পার্টির মহিলা এমপি মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ এখন চরম পর্যায়ে। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা জানান, পরীক্ষিত ও যোগ্য নেতাদের বদলে চাটুকার, তোষামোদকারী ও পরিবারের সদস্যদের অধিক গুরুত্ব এবং পদ-পদবী দেয়ায় এরশাদ এখন কার্যত নিজ দলে পরবাসী হয়ে গেছেন। দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শতকরা ৯৫ থেকে ৯৮ ভাগ নেতাকর্মী এখনো রওশন এরশাদকে নেতা মেনে নিতে নারাজ। তারপরও রওশন এরশাদের ক্ষমতায় ধরাশায়ী হয়ে গেছে এইচএম এরশাদ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের ৩ জন সদস্য জানান, এ জন্য এরশাদ নিজেই দায়ী। জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে;সাইজ করতে কারাগার থেকে চিরকুট লিখে;৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ রওশন এরশাদকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। সে খেসারত এখন দিতে হচ্ছে এরশাদকে তখন জাতীয় পার্টিতে জিনাতের যুগ। দলে কোনো পদ-পদবি না থাকার পরও জাতীয় পার্টিতে দুর্দান্ত প্রভাবশালী জিনাত হোসেন। কারাগার থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করে প্রতিটিতে জিতেছেন এইচএম এরশাদ। সংসদ সদস্য হিসেবে তাকে প্রাপ্ত মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না এ নিয়ে নেতাকর্মীরা মাঠের আন্দোলনে। দলের কা-ারী হিসেবে অবির্ভূত হয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক মিজানুর রহমান চৌধুরী। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলছে। রাস্তায় লাঙ্গলের মিছিল হলেই শাসক দলের হামলা হচ্ছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট এবং সায়েদাবাদে জাতীয় পার্টির সমাবেশ প- করে দেয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শাসক দলের ক্যাডাররা প্রবীণ নেতাদের শায়েস্তা করেছে। কারওয়ান বাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও মগবাজারের দলীয় কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. এমএ মতিন (দুই নেতাই মরহুম) পাল্টা জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। এ সময় দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠেন জিনাত মোশাররফ। সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী মহিলা পার্টির নেত্রী প্রবীণ নেত্রী মরিয়ম হাসিমুদ্দিনকে সরিয়ে মহিলা পার্টির সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় জিনাত মোশাররফকে। জাতীয় পার্টির চার খলিফা খ্যাত মিজানুর রহমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর আহমদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কেউ জিনাতকে মেনে নিতে রাজি নন। অতঃপর কারাগারের চিরকুটের জোরে সাবেক এক সচিবের এই স্ত্রী হয়ে উঠেন জাতীয় পার্টির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চার নেতা বাদে প্রায় সব নেতাই পদ-পদবির জন্য ছোটেন জিনাতের ডিওএইচএস-এর বাসায়। তোয়াজ করেন জিনাতকে। কারাগার থেকে চিঠি চালাচালি চলতে থাকে। বন্দী এইচএম এরশাদ বুঝে যান জিনাতকে দলের কা-ারী মিজানুর রহমান চৌধুরী মেনে নিচ্ছেন না। অতঃপর হঠাৎ রওশন এরশাদকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। বিক্ষুব্ধ প্রবীণ নেতা সেটা মেনে নিতেও বাধ্য হন। ৯৬ সালের নির্বাচনে এরশাদ কারাগার থেকেই প্রার্থী হন। নির্বাচনী তহবিল রওশন এরশাদ আর জিএম কাদেরের হাতে থাকায় রাজিয়া ফয়েজ (বর্তমানে মরহুমা), সরদার আমজাদ হোসেনসহ কমপক্ষে ১০ জন লাঙ্গলের প্রার্থী অর্থের অভাবে অল্প ভোটে পরাজিত হন। জাতীয় পার্টির বিদিশা জামানায় দীর্ঘ সাড়ে চার বছর রওশন এরশাদ দলের কোণঠাসা ছিলেন। পরবর্তীতে সরব হলেও দলীয় কর্মকান্ডে তাকে তেমন দেখা যেত না। ২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে গিয়ে জাতীয় পার্টিকে দ্বিখন্ডিত করেন বেগম রওশন এরশাদ। পরে আবার মূল দলে ফিরে আসেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ইস্যুতে এইচএম এরশাদের ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে ক্ষমতাসীনরা। তারা জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়ে এবং সংসদের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী করতে কৌশলে এরশাদকে বাদ দিয়ে রওশন এরশাদকে কাছে টেনে নেন। ফলে হঠাৎ করে রওশন এরশাদ হয়ে ওঠেন জাতীয় পার্টির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরশাদের ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, সিএমএইচ-এ দীর্ঘদিন আটক থাকা, গলফ খেলা, গোপনে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়া, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হওয়া, সংবাদ সম্মেলন করে আমি নির্বাচন করিনি ঘোষণা দেয়া, রংপুরে গিয়ে সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকবে ঘোষণা দেয়া, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়েও তাদের না আসা, সংরক্ষিত আসনে ৫ জনের নাম দেয়ার পর রওশন এরশাদের তা প্রত্যাখ্যান করা, পুরনো সিন্ডিকেটের কব্জায় আটকে পড়ায় পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা এখন আর এরশাদকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারা এরশাদকে এড়িয়ে চলছেন। আবার রওশন এরশাদের পক্ষে থাকা সংসদ সদস্যরা এরশাদের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করলেও এরশাদকে এড়িয়ে চলছেন। জানা যায়, সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি আসনের মধ্যে জাপার ভাগে পড়েছে ৬টি। এই ৬ আসনের বিপরীতে ৯৬টি মনোনয়নপত্র বিক্রি করা হয়। গত ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি চলে এ মনোনয়নপত্র বিক্রি। ২০ জানুয়ারি দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনানীস্থ কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে সৌজন্য বক্তব্য রাখেন। সেদিনই মহিলা এমপি হওয়ার জন্য যারা আবেদন করেছেন তারা দলীয় নীতি-নির্ধারকদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সূত্রের বনানী অফিসের এক কর্মচারীর স্ত্রী কনিকা রায়, বোন মেরিনা বেগম, কন্যা হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধার দিলারা খন্দকার, নারায়ণগঞ্জের অনন্যা হোসেন মৌসুমী ও নূর ই হাসনা লিলি চৌধুরী (সংরক্ষিত আসনে আগেও ৩ বার মহিলা এমপি হয়েছেন) নাম চূড়ান্ত করেছেন এরশাদ এমন গুজব ছড়ানো হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রওশন এরশাদ ও তার পক্ষের এমপিরা। সূত্রের দাবি এরশাদের দেয়া কোনো তালিকা দলীয় এমপিরা গ্রহণ করবেন না তা প্রায় নিশ্চিত। রওশনের পক্ষে থাকা জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিপ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ কযেকজন এমপি মিডিয়ায় এমন আভাস দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত মহিলা আসনের জন্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের গুডবুকে রয়েছে মহিলা পার্টির সভানেত্রী নূর-ই হাসনা লিলি চৌধুরী (কুড়িগ্রাম), শাহানারা বেগম (রংপুর), জাতীয় পার্টির ভাইস-চেয়ারম্যান মাহজাবীন মোরশেদ (চট্টগ্রাম), রওশনারা মান্নান (মানিকগঞ্জ), খোরশেদারা হক (কক্সবাজার)। এদের সবাইকে নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন মহিলা পার্টির নেত্রীরা। তারা বলছেন, নূরই-ই হাসনা লিলি চৌধুরী এ পর্যন্ত ৩ বার, মাহজাবীন মোরশেদ ১ বার ও রওশনারা মান্নান ১ বার এমপি হয়েছেন। এবার নতুনদের মনোনয়ন দিতে হবে। এ দাবিতে প্রয়োজনে রওশন এরশাদের বাসার সামনে অনশন করা হবে বলেও একাধিক মহিলা নেত্রী জানিয়েছেন। এক নেত্রী ইনকিলাবকে বলেন, দলে অনেক যোগ্য নারী নেত্রী কাজ করেন। তাদের সকলকে পর্যায়ক্রমে সুযোগ দেয়া উচিত। একজনকে বার বার সংরক্ষিত আসনে এমপি করা উচিত নয়। আমরা চাই দলের জন্য যারা কাজ করেন এবং অতীতে সংরক্ষিত আসনে এমপি হননি তাদের এমপি করা হোক। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য দলীয় চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, মহিলা আসন নিয়ে স্যার (এরশাদ) যতই দৌড়ঝাঁপ করুক কাজ হবে না। নিজ কর্মদোষে তিনি নিজ দলে পরবাসী হয়ে গেছেন। দল এখন চলবে ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) নির্দেশে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!