সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবার সঙ্গে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপণের ঘোষণা দিয়েছেন। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলে তারা দেশটির ওপর থেকে গত ৫০ বছর ধরে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় ‘At last Cuba is free to become more like the glorious US of A!’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন ব্রিটিশ কলামিস্ট মার্ক স্টিল। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী এই লেখকের নিবন্ধটি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য ভাষান্তরিত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে অর্ধ শতাব্দী কেটে গেছে। এই ৫০ বছর ধরে দেশটার বারোটা বাজানোর জন্য তো কম চেষ্টা করা হয়নি। কখনো একে অনাহারে রেখে, কখনো বা দেশটির নেতাকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করে এবং দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছিল না, তখনই আপনারা ক্লান্ত হয়ে গেলেন এবং বললেন যাও তোমাদের ছেড়ে দিলাম।
হতে পারেন আপনি আমেরিকার একজন পাঁড় সমর্থক এবং এদের নানা রকম ছলাকলায় আপনি মুগ্ধ। এতসব ষড়যন্ত্রের পর আপনারা এখন কিউবাকে বলছেন, ‘তোমরা বাপু, এবার একটু বদলানোর চেষ্টা কর, তবেই আমরা তোমার সঙ্গে আবার লেনদেন শুরু করতে পারি।’ এ যেন টাইগার উডস (বিখ্যাত গলফ খেলোয়ার)তার সাবেক স্ত্রীকে বলছেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে আমি আবার ঘরে তুলতে পারি। তবে এর আগে তোমাকে আরো সহবত শিখতে হবে- আরো দায়িত্ববান হতে হবে।’
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো কিন্তু কিউবার একজনকেই ভয় পায়, তিনি হলেন ফিদেল কাস্ত্রো। গত ৫০ বছর ধরে তাকে হত্যা করার কম চেষ্টা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন এই ষড়যন্ত্রই যেন তাকে দীর্ঘ দিন ধরে সচল রেখেছ এবং কর্মোদ্দীপণা যুগিয়েছে।
এটা প্রায়ই বলতে শোনা যায়, যদি কাউকে আপনি প্রভাবিত করতে চান তবে ১৮ বছর বয়সটাই হল সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এজন্যই হয়ত কিউবান এই নেতাকে হত্যা করতে ছয়শ’র বেশি পরিকল্পনা করেছিল সিআইএ। কখনো তার পোশাকে বিষ মাখিয়ে এবং কখনো বা তার সিগারের পাইপে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে।এক আমেরিকান নাকি গোটা এক মাস ধরে তাকে হত্যার জন্য ঘুরেছিলেন, তার কফিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন-এরপরও নিজের পায়ে ভর করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেরিয়েছেন কাস্ত্রো।
এদিকে ওবামার ওই ঘোষণায় ক্ষেপেছেন বহু রিপাবলিকান নেতা। কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো ধরণের চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই দেখছেন তারা। তাদের যুক্তি হল, কিউবার ওপর কমসে কম ১৩০ বছর মার্কিন অবরোধ বলবৎ থাকা উচিত। মাত্র তো ৫০ পেরিয়েছে- আরো ৯০ বছর বছর যাক। তারপরেই না একে কায়দা মত হজম করা যাবে।
তারা এখনও কোন যুগে আছে সেটা চিন্তা করুন। যেন সেই রোমে বসে আছি আর হাই তুলে বসছি,‘ওহ, কার্থাজের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়া হয়েছে, না, আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
অথচ আপনাদের তো এ কথা অজ্ঞাত নয়, কাস্ত্রোর প্রতি এতটা শক্রতা কেন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, তিনি নিজের দেশের শত শত বিরোধী নেতাদের জেলে পুরেছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে খাপ খায় না। তাহলে কি এখন তারা কিউবাকে বলবেন,‘না, যথেষ্ট হয়নি। এখন যদি তুমি আমাদের সমর্থন পেতে চাও, তাহলে আরো বেশি মানুষকে জেলে পুরে রাখ।’যেমনটা করেছিলেন চিলির স্বৈরশাসক জেনারেল পিনচেট। তিনি তো হাজার হাজার লোককে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়েছিলেন এবং কারাবন্দি করেছিলেন কয়েক লাখ মানুষকে।
রিপাবলিকান নেতারা এখন বায়না ধরেছেন, কিউবার সঙ্গে চুক্তি করার আগে তাদের কাছ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে।এটা তো নতুন কিছু নয়। গত ৫০ বছর ধরে মার্কিন নীতি নির্ধারকেরা তো গোটা বিশ্ব জুড়ি এই একটি জিনিসই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। চিলির পিনাচোট, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, কুয়েতের আমির এবং সৌদি রাজ পরিবারগুলোর কাছে তো তারা এই গণতন্ত্রই চেয়েছিলেন।কিন্তু মজার বিষয় হল, ইরানের রেজা শাহ পাহলবি, ফিলিপাইনের ফার্ডিনান্দ মার্কোস এবং আল কায়দা প্রধান বিন লাদেনের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে তাদের কোনোই সমস্যা হয়নি, যদিও তারা কেউই গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না, কম বেশি এরা সবাই ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক।
কিউবায় কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার আগে ১৯৪৪ এবং ১৯৫২ সালে দু দু বার ক্ষমতা দখল করেছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ফুলগেনসিও বাতিস্তা। তখন কিন্তু ধনকুবের ওই গ্যাস্টারকে স্বীকৃতি দিতে কোনোই সমস্যা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের। তখন মাফিয়া চক্র দ্বারা চালিত বাতিস্তা সরকারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার ওপর বেশ কয়েকটি চুক্তিও করেছিল ওয়াশিংটন। তার প্রতি এতটাই সন্তোষ্ট ছিল ওয়াশিংটন যে, ‘আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ।
তাকে হটিয়ে যখনই ক্ষমতায় এলেন ক্রাস্ট্রো তখনই যেন সব বদলে গেল। কিউবা হয়ে গেল আমেরিকার শত্রু দেশ। অথচ অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিউবা অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকার মত আধুনিক ব্যবস্থা বহাল ছিল। উদাহরণস্বরূপ তাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা যায়। কিউবার এই খাতটিকে বিশ্বের সবচাইতে কার্যকরী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বললেও উল্লেখ করা যায়।
কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। আমিরকা তো এটাই চেয়েছিল, কিউবা যেন কোমর সোজা করে না দাঁড়াতে পারে। এজন্যই তারা সেখানে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দেয়ানি। এসবই করা হয়েছে কমুনিজমের বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ হিসেবে।
এ যেন আমার দরজার পাশের প্রতিবেশী, যার ঘরে টেলিভিশন নাই বলে আমি তাকে খোঁটা দেই। তখন সে আমার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ করে। গত ৫০ বছর ধরে আমি তার বাড়ি থেকে সব হাতিয়ে নিচ্ছি ফলে সে তার সব অভাব মেটাতে পারছে না।
গত পাঁচ বছর ধরে কিউবা সরকার ভিন্ন মতাবলম্বীদের জেলে পুরেছে। তবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও একসময় রাশিয়ার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। ‘বে অব পিগস’(লাটিন আমেরিকার দেশসমূহ)য়ের বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর নিজেকে একমাত্র কমুনিস্ট হিসেবে ঘোষণা করেছিরেন কাস্ত্রো। তখন কাস্ত্রোকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশল অবলম্বন করেছিল। তবে কেবল মাত্র একজনই এটি বাস্তবায়নে সফল হয়েছিলেন।
কাস্ত্রোকে ক্ষমতাচ্যূত করতে যারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছিলেন, ওবামার ঘোষণায় তারা এখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন।নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বও গড়ে তুলতে পারেন। বিশেষ করে আমেরিকার সেসব নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদরা, যারা কিউবার ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের কনিষ্ঠ পুত্র জেব বুশ এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। কিউবায় কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্টা করা যায় এ নিয়ে তারা অন্য মার্কিনীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। ক্ষমতা কেবল একটি বা দুটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এ কেমন কথা!